সুলতানি আমলে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার উপর মাহুয়ানের বিবরণ কী আলোকপাত কর
সুলতানি আমলে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার উপর মাহুয়ানের বিবরণ কী আলোকপাত কর |
সুলতানি আমলে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার উপর মাহুয়ানের বিবরণ কী আলোকপাত কর
উত্তর : ভূমিকা : সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলা ছিল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। বাংলার ধনসম্পদ দেখে পর্যটকরা মুগ্ধ হন। তেমনি চীনা পর্যটক মাহুয়ান বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন।
তিনি তার বিবরণীতে বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক তুলে ধরেন। বাংলাতে বিভিন্ন পেশার লোক বসবাস করতো। তাদের জীবনযাত্রা ছিল বৈচিত্র্যময়।
→ সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা : মাহুয়ানের বিবরণ থেকে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. বৈদেশিক বাণিজ্য : তিনি বলেন ধনীরা জাহাজ তৈরি করতো এবং তা দিয়ে বিদেশি সাথে বাণিজ্য চালাত। দেশি পণ্যসামগ্রী জাহাজে করে বিদেশে নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো ।
২. মুদ্রা : এদেশের মুদ্রা ছিল রুপার। এটিকে টাকা বলা হতো। এর ব্যাস ১.২ ইঞ্চি। এর দুপিঠেই খোদাই করা থাকতো। মুদ্রা ব্যবসায় বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৩. শিল্প দ্রব্যাদি : মাহুয়ান বলেন শিল্প দ্রব্যের মধ্যে বাংলাদেশে দু'রকমের সূক্ষ্ম তুলা উৎপন্ন হতো। এখানে তুঁত গাছ ও গুটি পোকার চাষ হতো।
৪. মদ ব্যবসা ও জুয়া খেলা : মাহুয়ান বলেন তখন তিন চার রকমের মদ পাওয়া যেত। নারকেল, ধান, তাড়ি এবং খেজুর থেকে তৈরি মদ বিক্রি করা হতো। এছাড়া জুয়া খেলা জমজমাট ছিল ।
৫. ব্যবসা-বাণিজ্য : মাহুয়ান সমুদ্র বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন সমুদ্র বন্দরের সাহায্যে বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো ।
৬. পোশাক ও উৎপন্ন দ্রব্য : বঙ্গের অধিবাসীগণ ব্যবসা ও কৃষিকাজ করে জীবিকানির্বাহ করতো। ধনী সম্প্রদায় জাহাজ নির্মাণ কারখানা স্থাপন করে। বহির্বাণিজ্য পরিচালনার জন্য জাহাজ তৈরি করতো।
→ বাংলার সামাজিক অবস্থা : মাহুয়ানের বিবরণ থেকে বাংলার সামাজিক অবস্থা নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. রাজপ্রাসাদ : মাহুয়ান তার গ্রন্থে বঙ্গকে একটি বড় দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন রাজধানীর রাজপ্রাসাদ ও রাজগৃহে বাস করতেন সুলতান ও তার সভাসদে রাজপ্রাসাদটি সুরক্ষিত ছিল।
২. বঙ্গবাসীর চালচলন : মাহমান বলেন রাজধানীর অধিকাংশ মানুষ ছিল মুঘলমান। তারা কৃষ্ণবর্ণ ও মুণ্ডিত কেশ | কিন্তু তাদের মস্তকে শ্বেতবর্ণের শিরস্থান এবং কোমরে রঙিন কোমরবন্ধ থাকতো।
৩. সেনাবাহিনী : তিনি বলেন বঙ্গে একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল। | প্রধান দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে তাদেরকে বেতন প্রদান করা হতো।
৪. প্রশাসন ব্যবস্থা : মাহুয়ানের বিবরণী থেকে জানা যায় যে এদেশ চীনের ন্যায় বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীদের সরকারি আবাস ছিল, রাজকর্মচারীদের জন্য নিজস্ব সীলমোহরও ছিল "এবং দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে তাদের বেতন দেয়া হতো।
৫. পোশাক পরিচ্ছেদ : মাহুয়ান বলেন হিন্দু ও মুঘলমানদের মধ্যে উচ্চপদস্থ লোকেরা মাথায় সাদা পাপরি ব্যবহার করতো। তারা লম্বা এক ধরনের জামা পরতো এবং তাতে গোল গ্রীবা বেষ্টনী থাকত। স্ত্রীলোকেরা খাটো জামার উপর | সিদ্ধ সুতি কাপড় ঘুরিয়ে পরিধান করতো।
৬. অধিবাসী ও সংস্কৃতি : তিনি বলেন তৎকালে বাংলার অধিবাসী ছিল দুই ধরনেরী যথা- হিন্দু ও মুসলিম। তাদের সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন। হিন্দুরা গরুর মাংস খেত না। স্বামী-স্ত্রী একসাথে বসে আহার করার প্রচলন ছিল না। হিন্দু সমাজে বহু বিবাহের প্রচলন ছিল অনুপস্থিত।
৭. নগর সমাজ : মাহুয়ান বলেন বাংলাদেশে বহু প্রাচীরবেষ্টিত নগরী ছিল। তাদের মধ্যে লখনৌতি অন্যতম। রাজধানীর অধিকাংশ অধিবাসী ছিল মুঘলমান এবং ভানের ব্যবহার ছিল সহজ-সরল।
৮. অতিথি আপ্যায়ন : মাহুয়ান বলেন তৎকালীন বাংলাদেশে চা উৎপন্ন হতো না বলে অতিথি আপ্যায়নের সময় তার চায়ের পরিবর্তে তাম্বল পান দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মাহুয়ানের বিবরণ থেকে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। বাংলার সমাজে বিভিন্ন ধর্মের ও পেশার লোক মিলেমিশে বসবাস করতো।
বিপদ-আপদে একজন আরেকজনকে সাহায্য-সহযোগিতা করতো। তাছাড়া বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল উন্নত। কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো।