সুলতানি আমল ও মুঘল আমলে বাংলায় লিখিত উৎসসমূহের বর্ণনা দাও
সুলতানি আমল ও মুঘল আমলে বাংলায় লিখিত উৎসসমূহের বর্ণনা দাও |
সুলতানি আমল ও মুঘল আমলে বাংলায় লিখিত উৎসসমূহের বর্ণনা দাও
- অথবা, মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের লিখিত উৎসসমূহের বর্ণনা দাও।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হয় ১২০৪ সালে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুসলিম শাসনামলে বাংলার লিখিত কোনো ইতিহাস গ্রন্থ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।
সমসাময়িককালে রচিত আকর গ্রন্থ-এর অভাবে মুসলিম শাসনামলের বাংলাদেশের ইতিহাস পুনর্গঠন করা কঠিন, তবে একেবারে অসম্ভব নয়।
কারণ দিল্লিতে লিখিত আকর গ্রন্থ এবং বাংলায় প্রাপ্ত সূত্রে এমন অনেক তথ্য পাওয়া যায়, যার সাহায্যে আধুনিক পণ্ডিতগণ বাংলা ইতিহাস পুনর্গঠন করার প্রয়াস পেয়েছেন।
মধ্যযুগে সুলতানি ও মুঘল আমলে বাংলাকেন্দ্ৰিক ও বাংলা সম্পর্কিত যা কিছু লিখিত উৎস আছে নিম্নে সেগুলো বিবরণ দেওয়া হলো ।
মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসের লিখিত বা আকরগ্রন্থ : বাংলার মুসলিম আমলের ইতিহাস অধ্যয়নে আকর গ্রন্থসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো :
সুলতানি আমলের আকরগ্রন্থ : সুলতানি আমলে বাংলা সম্পর্কিত আকর গ্রন্থসমূহ হচ্ছে :
১. তারিখ-ই-ফিরোজশাহী : 'তারিখ-ই-ফিরোজশাহী" রচনা করেন জিয়াউদ্দিন বারানী। সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবনের রাজত্বকালে (১২৬৬-১২৮৭ সাল) দিল্লিতে জন্ম নেন।
বারানীর এ গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ছিল গিয়াস উদ্দিন বলবনের সিংহাসনারোহণের (১২৩৬ সাল) সদর থেকে সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলকের রাজত্বকালের প্রথম ছয় বছর (১৩৫৭ সাল) পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস।
বাংলার ঘটনা জানার জন্য তিনি বাংলা প্রত্যাগত সৈনিক বা সুলতানের দরবারস্থ নবীর বা সেক্রেটারিদের নিকট হতে সংবাদ সংগ্রহ করতেন।
বারনী যে সময়ে ইতিহাস লিখেন (১২৬৫-১৩৫৭ সাল) তার অধিকাংশ সময়ে বাংলা স্বাধীন ছিল। তাই হয়তো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলা সম্পর্কে যথাযথ খরচ সংগ্রহ করতে পারেননি।
মাত্র দুই-একটি বিষয় ছাড়া বারণীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতেও বাংলার ঘটনাবলি অভিসংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে।
২. তবাকাত-ই-নাসিরী : মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে আকর গ্রন্থগুলোর মধ্যে মিনহাজ-ই-সিরাজের 'তবাকাত-ই-নাসিরী' সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। মিনহাজ দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ ও তার উত্তরাধিকারীদের সময়ে দিল্লির কাজীর পদ অলঙ্কৃত করেন।
এ গ্রন্থে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে একটি অধ্যায় সংযোজন করা হয়েছে। বাংলায় অবস্থানের সময় মিনহাজ বাংলা বিজয় সম্পর্কিত তথ্যাদি অনুসন্ধান করেন।
বখতিয়ার খলজির সময়কালে (১২০৪-১২০৬ সাল) সৈনিকদের মধ্যে মুতামিদ-উদ-দৌলা নামক এক ব্যক্তির নিকট থেকেও তিনি তথ্যাদি সংগ্রহ করেন।
তাছাড়া মিনহাজ দিল্লির আমিরদের সম্বন্ধে আলোচনা করার সময় লখনৌতিতে নিযুক্ত গভর্নরদের কার্যকলাপ সম্পর্কেও বেশ আলোকপাত করেন।
৩. তারিখ-ই-ফিরিশতা : আঙ্গুল কাসিম ফিরিশতা রচিত 'তারিখ-ই-ফিরিশতা' বিজাপুরের সুলতান ইব্রাহিম আদিল শাহের সময়ে লেখা।
নিজাম উদ্দিন আহমদ বখশীর মতো ফিরিশতা ও তার গ্রন্থে সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে একটি পৃথক অধ্যায় সংযোজন করেছেন।
৪. ফুতুহ-উস-সালাতিন : খাজা আব্দুল মালিক ইসামী ১৩৪৯ সালে 'ফুতুহ-উস-সালাতিন' গ্রন্থটি রচনা করেন। সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক রাজধানী স্থানান্তর করলে ইসামী নিখি থেকে দেবগিরি চলে যান।
সেখানে ইসামী প্রথম বাহমনী সুলতান আলাউদ্দীন হাসাহের সময়ে তার ইতিহাস গ্রন্থখানি রচনা করেন | গ্রন্থটি কবিতায় লিখিত বিধায় অনেক পণ্ডিত মনে করেন গ্রন্থটি অভিরঞ্জন দোষে দুষ্ট।
ইসামী কখনো বাংলায় না আসলেও তার গ্রন্থে বাংলা সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য পাওয়া যায়, যা জিয়াউদ্দীন বারানীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে পাওয়া যায় না।
এতে মনে হয় যে, বিদ্রোহী বাহমনী রাজ্যের সাথে বিদ্রোহী বাংলার ভালো সম্পর্ক ছিল এবং উভয় দেশের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।
৫. তারিখ-ই-মোবারকশাহী : দিল্লির সুলতান মোবারকশাহীর রাজত্বকালে (১৪২১-১৪৩৪ সাল) ইয়াহইয়া বিন আহমদ বিন আব্দুল্লাহ সরহদী তার 'তারিখ-ই-মোবারকশাহী" গ্রন্থটি রচনা করেন।
বইটিতে সুলতান মোহাম্মদ ঘুরী হতে আরম্ভ করে ১৪২৪ সাল পর্যন্ত দিল্লির সুলতানদের ইতিহাস লিখিত হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে লেখক বাংলার ইতিহাস সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। 'তারিখ-ই-মোবারকশাহী'-তে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বেশ নির্ভুল একথা প্রমাণিত হয়েছে।
৬. তারিখ-ই-ফিরোজশাহী : শামস-ই-সিরাজ আফিফ রচিত 'তারিখ-ই-ফিরোজশাহী' গ্রন্থে দিল্লির সুলতান ফিরোজশাহী তুঘলক কর্তৃক বাংলা আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায়।
আফিফ সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলকের (১৩৫১-১৩৮৮ সাল) নিমক খোর ছিলেন বিধায় তিনি ফিরোজশাহের বাংলা আক্রমণ সম্পর্কে লিখবার সময় অহেতুক সুলতানের গুপ্তগান করেছেন।
৭. তারিখ-ই-শেরশাহ, তারিখ-ই-খান জাহানী, তারিখ-ই- দায়ুদী ও তারিখ-ই-শাহী : ১৫৩৮ সালে শেরশাহ বাংলা জয় করার পর ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলা আফগান শাসনাধীনে ছিল। কয়েকজন আফগান ঐতিহাসক এসময়ে ইতিহাস রচনা করেন।
যথা- আববাস স্থান সেরওয়ানীর 'তারিখ-ই-মোবারকশাহ', খাজা নিয়ামত উল্লাহের 'তারিখ-ই-জাহানী', মখজন-ই-আফগানী ও আব্দুল্লাহর 'তারিখ-ই-দায়ূদী' ও আহমদ মিয়াগারের 'তারিখ-ই- শাহী' প্রভৃতি। বাংলায় আফগান ইতিহাস রচনার জন্য এ গ্রন্থগুলো অত্যন্ত মূল্যবান।
৮. কিরান-উস-সালাইন : আমীর খসরুর "কিরাণ-উস-সাদাইন' ফারসি ভাষায় লিখিত একখানি বিখ্যাত বই। বাংলার সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ বগরা খান ও তার পুত্র দিল্লির সুলতান মুইজউদ্দীন কায়কোবাদের মিলন কাহিনি এ গ্রন্থ বর্ণনা করা হয়েছে।
৯. রিয়াজ-উস-সালাতিন : সৈয়দ গোলাম হোসেন সনীম জাইদপুরী বাংলায় বসে 'রিয়াজ-উস-সালাতিন' গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি মালদহের ইংরেজ কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট জর্জ উত্তনীয়' অধীনে ডাক বিভাগে পোস্ট মাস্টারের চাকরি করেন এবং জর্জ উত্তনীর আদেশে এ গ্রন্থটি রচনা করেন।
তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে গৌড় ও পাণ্ডুয়া থেকে ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করেন। এমনকি শিলালিপির তথ্যাসিও সংগ্রহ করেন। তিনি সুলতান আমলের মুদ্রার সাথেও পরিচিত ছিলেন।
সমসাময়িক বা পরবর্তীকালের ইতিহাস গ্রন্থগুলোর মধ্যে একমাত্র রিয়াজ-উস-সালাতিনেই বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা, উৎপন্ন কৃষি ও শিল্প দ্রব্যাদির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
১০. জাফর-উল-ওয়াদিত বা মোজাফ্ফর ও আলিহ আব্দুল্লাহ : মোহাম্মদ বিন উমর মক্কী ওরফে হাজী দবির সতেরো শতকের প্রথমদিকে আরবি ভাষায় গুজরাটের ইতিহাসের উপর 'জাফর-উল-ওয়ালিত বা মোজাফ্ফর ও আলিহ' গ্রন্থটি রচনা করেন। এ বইটিতে সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কিত একটি অধ্যায় সংযোজন করা আছে।
মুঘল আমলের আকর গ্রন্থ মুঘল আমলে বাংলা সম্পর্কিত আকর গ্রন্থসমূহ হচ্ছে-
১. আকবরনামা : সম্রাট আকবরের সময় লিখিত তার সভাকবি আবুল ফজলের 'আকরনামা' একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থে বাংলার স্বাধীন কররানী সুলতানদের পতন এবং সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা বিজয়ের কাহিনি পাওয়া যায় ।
২. মুস্তাখাব-উত-তাওয়ারীখ : সম্রাট আকবরের সময় লিখিত আব্দুল কাদের বদায়ূনীর 'মুস্তাখাব-উত-তাওয়ারীখ' একটি আকর গ্রন্থ। লেখক দিল্লির সুলতানসের ইতিহাস লেখার সাথে সাথে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন।
৩. আইন-ই-আকবরী : আবুল ফজলের 'আকবরনামা' গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড 'আইন-ই-আকবরী'। এ গ্রন্থে থাক্ মুঘল যুগে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে।
এছাড়া বাংলায় সুফিদের জীবন প্রণালি, প্রশাসনিক বিভাগ, ভূমি রাজস্ব, উৎপন্ন কৃষি ও শিল্প দ্রব্যাদির বিবরণ পাওয়া যায়। বাংলার ভৌগোলিক অবস্থাও জানা যায়।
সুফিদের জীবনচরিত ও তাদের লেখা চিঠিপত্র : সুফিদের জীবনচরিত ও তাদের লেখা চিঠিপত্র মধ্যযুগের বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনার অন্যতম উৎস। সুফি-সাহিত্য বাংলার সামাজিক ইতিহাস প্রণয়নে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
সুফি সাহিত্যের মধ্যে আমীর থুরদের 'সিয়ার-আল-আউলিয়া', মওলানা জামালীর 'সিয়ার-আল-আরিফিন', শেখ আব্দুল হক দেহলভীর 'আখবাব- আল-আখিয়ার' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
সমসাময়িক সাহিত্য : সমাসাময়িক সাহিত্য সেকালের সামাজিক জীবনের উপর ব্যাপক আলোকপাত করে থাকে। মুঘলমান লেখকগণের লিখিত গ্রন্থাবলির মধ্যে কিছু সংখ্যকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
যেমন- শাহ মুহাম্মদ সগীরের 'ইউসুফ-জোলেখা', জৈনুদ্দিনের 'রসূল বিজয়', কবি মুজাম্মিলের 'সাতনামা' ও 'নহিহতনামা', দৌলত উজির বাহরাম খানের 'লায়লী-মজনু' ও মুহাম্মদ কবীরের 'মধুমালতী'।
হিন্দু কবিদের মধ্যে বিজয়গুপ্ত, বংশীবদন, ক্ষেমানন্দ ও বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল' কাব্যগুলো এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ ও গোবিন্দ দাসের 'চৈতন্য জীবনী' কাব্যগুলো এবং মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ হরিরাম ও অন্যদিকে চণ্ডীকাব্যসমূহ মুঘলমান যুগের বাংলা সমাজ সম্বন্ধে গবেষণার জন্য অপরিসীম মূল্য বহন করছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, মধ্যযুগের নির্ভুল ইতিহাস রচনা করা অনেকটা অসম্ভব। তবে সমস্ত উপাদানকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ইতিহাস লিখলে তা মানসম্মত হবে।
ইতিহাস রচনায় বিশেষ কোনো উপাদানকে তুলনামূলক বেশি গুরুত্ব দেয়া বা অন্য কোনো উপাদানকে বাদ দেয়া যাবে না। মধ্যযুগ সম্পর্কে আমাদেরকে জানতে হলে, সে যুগের যথার্থ ইতিহাস জানতে হবে।
সুতরাং মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস রচনা করতে হলে সে যুগের ইতিহাস রচনার বিভিন্ন প্রকারের উপাদানসমূহের সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন ।