সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনামল আলোচনা কর
সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনামল আলোচনা কর |
সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনামল আলোচনা কর
- অথবা, সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলায় সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজশাহের শাসনামল ইতিহাসে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
বখতিয়ার খলজির পর শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সময়েই মুসলিম রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করে। ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার মুসলিম রাজ্যের এই বিস্তৃতি এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শুধুমাত্র রাজ্যবিস্তার নয়, ধর্মীয় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও এ সময়ে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়।
→ শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের পরিচয় ও ক্ষমতা গ্রহণ : শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের বংশ পরিচয় সম্বন্ধে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর উৎপত্তি ও ক্ষমতা লাভ সম্পর্কেও সঠিক কিছু জানা যায় না।
এই সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যেসব মতবাদ রয়েছে তা আনুমানিক। বলবন বুঘরা খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে ফিরে যাওয়ার সময়ে তাঁকে উপদেশ ও সাহায্য দানের জন্য দুইজন বিচক্ষণ ব্যক্তিকে বাংলায় রেখে গিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক ইসামির মতে এই দুজনের নামই ছিল ফিরোজ। বারানী একজনের নাম শামসুদ্দিন বলে উল্লেখ করেছিলেন।
অনুমান করা হয় যে, কায়কাউসের রাজত্বকালে বিহারের শাসনকর্তা ফিরোজ ইতিগান খুব সম্ভবত এই দুইজনের মধ্যে একজন এবং তিনিই পরবর্তীকালে ক্ষমতা দখল করেন।
কায়কাডস হয় অপুত্রক অবস্থায় মারা এবং ফিরোজ ক্ষমতা দখল করেন, কিংবা এমন হতে পারে যে, জয়কাউসকে অপসারিত করে ফিরোজ ক্ষমতা অধিকার করেন।
তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, উভয় সিদ্ধান্তই আনুমানিক যাইহোক, কোন এককভাবে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ক্ষমতা দখল | করেন এবং ১৩০১ খ্রস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনকাল : শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনকাল সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
১. রাজ্যবিস্তার : বখতিয়ার খলজির পর সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজা শাহের সময়েই বাংলায় মুসলিম রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করে। ইতিপূর্বে বাংলার মুসলিম রাজ্য বিহার, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় লখনৌতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।
সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সময়েই বঙ্গ ও সাতগাঁও জয় সম্পন্ন হয়। শামসুদ্দিন ফিরোজের সময় সোনারগাঁও অঞ্চল স্থায়ীভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
সোনারগাঁও এবং সাতগাঁও ছাড়াও ফিরোজের শাসনকালে ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চল মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
এক কথায় বলা যায় যে, প্রত্যন্ত এলাকা ছাড়া প্রায় সমগ্র বাংলা সুলতান শামসুদ্দিন পিরোজের সময়ে মুঘলমানদের অধিকারে আসে। নিম্নে তার রাজ্যবিস্তার সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো :
২. সাতগাঁও বিজয় : সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনামলে সাঁতগাও মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। তবে সাতগাও বিজয়ের সুস্পষ্ট ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা কষ্টসাধ্য।
সুলতান রুকনউদ্দিন কায়কাউসের উৎকীর্ণ এক শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, জাফর খান নামক তার এক শাসনকর্তা সাতগাও-এ একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন।
শামসুদ্দিন ফিরোজের রাজত্বকালে ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে উত্তীর্ণ আর একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, জাফর খান, 'দার-উল-খয়রাত' নামক একটি মাদরাসা নির্মাণ করেছিলেন।
মূলত সুলতান রুকনউদ্দিন কায়কাউসের সময়ে ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম সাতগাঁও অঞ্চলে মুসলিম বিজয় শুরু হয়। আর শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সময় তা সম্পন্ন হয়।
৩. সিলেট ও ময়মনসিংহ বিজয় : সুলতান শামসুদ্দিনের সময়ে সিলেট অঞ্চল জয় করা হয়েছিল। ঐ অঞ্চলে আক্রমণের পূর্বে ময়মনসিংহ এলাকাও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।
ময়মনসিংহ বিজয়ের কোনো বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু ফিরোজ শাহের পুত্র গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর গিয়াসপুর টাকশাল থেকে ৭২২ হিজরীতে মুদ্রা প্রকাশ করেছিলেন।
গিয়াসপুর ময়মনসিংহের প্রায় ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত ঐ নামের একটি গ্রামের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়। সিলেটে শাহজালালের দরগাহে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজের শাসনকালে ১০০০ খ্রিস্টাব্দে ঐ অঞ্চল বিজিত হয়েছিল।
শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের কৃতিত্ব : সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ একজন যোগ্যতাসম্পন্ন উচ্চস্তরের রাজনীতিবিদ ও শাসক ছিলেন।
কোনো রাজবংশের লোক না হয়েও তিনি একজন দক্ষ শাসক হিসেবে বাংলা শাসন করেন এবং দিতির খলজি সুলতানদের আক্রমণ থেকে লখনৌতির মুসলিম রাজ্য রক্ষা করেন। তার রাজত্বকালে মুসলিম রাজ্যের বিস্তৃতি এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
নিম্নে তার 'কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো-
১. মুসলিম রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তার : বাংলায় মুসলিম রাজ্যের পরিধি সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলেই। ইতিপূর্বে বাংলার মুসলিম রাজ্য বিহার, উত্তর ও উত্তর- পশ্চিম বাংলা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় লখনৌতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।
ফিরোজ শাহের সময় বঙ্গ, সাতগাঁও, সোনারগাঁও, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল মুঘলমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এক কথায় বলা যায়। যে, প্রত্যন্ত এলাকা ছাড়া প্রায় সমগ্র বাংলা সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজের সময়ে মুঘলমানদের অধিকারে আসে।
২. ইসলাম প্রচার : সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনামলে শুধু বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তার লাভই করেনি, ইসলাম প্রচারও বৃদ্ধি পায়। সাতগাঁও ও সিলেট বিজয়ে দুজন বিখ্যাত সুফির নাম জড়িত। এসব সুফি-সাধকরা বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন।
৩. মুদ্রা প্রকাশ : সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনকার্যে তার তিনপুত্র সাহায্য করেছিলেন। ফিরোজ শাহের জীবিতাবস্থায় তার পুত্র জালালউদ্দিন মাহমুদ, গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর ও শিহাবউদ্দিন বোঘসা লানৌতির টাকশাল থেকে নিজেদের নামে মুদ্রা জারি করেছিল। গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর সোনারগাঁও এবং গিয়ালপুর টাকশাল থেকেও সুদক্ষ প্রকাশ করেছিলেন।
৪. প্রজাহিতৈষী শাসক ; সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ একজন প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। প্রজাদের কল্যাণে তিনি অনেক জনহিতকর কার্য-সম্পাদন করেন।
ফিরোজ শাহ বিচার ব্যবস্থার কঠোরতা দূর করেন, সেচ কার্যের জন্য খাল খনন করেন এবং আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক উঠিয়ে দিয়ে জনসাধারণের প্রভুত উন্নতি সাধন করেছিলেন।
৫. স্থাপত্যে ও নির্মাণে অবদান : নির্মাতা হিসেবে ফিরোজ শাহের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি অসংখ্য মসজিন, সরাইখানা প্রভৃতি স্থাপন করেন এবং ফিরোজপুর ফিরোজাবাদ, জৌনপুর প্রভৃতি শহরের গোড়াপত্তন করে তার নির্মাণ শিল্পানুরাগের পরিচয় দিয়েছিলেন।
৬. দক্ষ শাসক : শামসুদ্দিন ফিরোজশাহ একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। শাসনকার্যে তার অসাধারণ দক্ষতার ফলে খলজি মালিকদের অন্তর্বিরোধের অবসান ঘটে। তার শাসনামলে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং রাজ্যের উন্নতি ঘটে।
৭. নিষ্ঠাবান মুঘলমান : শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ একজন নিষ্ঠাবান ও ধর্মানুরাগী মুঘলমান ছিলেন। সুফিদের ইসলাম প্রচারে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করতেন।
উপসংহার ; পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য সুদৃঢ়ীকরণ ও বিস্তৃতকরণে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজা শাহ অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তার শাসনামলেই সর্বপ্রথম প্রায় সমগ্র বাংলা মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
এছাড়া একজন দক্ষ শাসক হিসেবে তিনি বাংলায় সুশাসন কায়েম করেছিলেন। তাই সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজশাহকে বাংলার প্রথম সাম্রাজ্যবাদী সুলতান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।