সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির রাজত্বকাল বিবরণ দাও
সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির রাজত্বকাল বিবরণ দাও |
সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির রাজত্বকাল বিবরণ দাও
- অথবা, সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির শাসনকাল আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজির শাসনকাল মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসের একটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন।
ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর বাংলার মুসলিম রাজ্যের শাসন ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে তার সহচরদের মধ্যে যে উত্তরাধিকার সংঘাত শুরু হয় তার পতন ঘটিয়ে নিজ যোগ্যতা, বিচক্ষণতা ও দক্ষতাবলে গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করেন।
এছাড়া তিনি বাংলার বাইরেও মুসলিম রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেছিলেন। ১২১২-১২২৭ সালে পর্যন্ত ১৫ বছরের শাসনকালে ইওয়াজ খলজি বাংলার মুসলিম রাজ্যকে ক্ষমতার স্বর্ণ শিখরে উন্নীত করেছিলেন।[
সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির পরিচয় : সুলতান পিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির প্রকৃত নাম ছিল হুসাম উদ্দিন ইওয়াজ বা ইয়াজ খলজি। তিনি গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি নামে পরিচিত ছিলেন।
তার পিতার নাম ছিল হুসেন। তিনি আফগানিস্তানের পরম শিরের অধিবাসী ছিলেন। ইওজ খলজির প্রথম জীবনে ভাগ্যান্বেষণের জন্য ভারতবর্ষে আগমন করে এবং বখতিয়ার খলজির সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
বখতিয়ার খলজি বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করলে ইওজ খলজিকে গঙ্গাতরীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। এরপর তিনি ইওজ খলজিকে বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র দেবকোটের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।
১২১০ [ সালের আলীমর্দান খলজির দিল্লির অধীনস্থ লখনৌতির শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড শুরু করলে খলজি আমীরদের সাহায্য ইওজ খলজি আলী মর্দানকে হত্যা করেন।
অতঃপর ১২১২ সালে হুসাম উদ্দিন ইওজ খলজি পিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি উপধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসনের আরোহণ করেন।
— সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির রাজত্বকাল : নিম্নে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির রাজত্বকাল আলোচনা করা হলো :
১. রাজধানী স্থানান্তর : সিংহাসনে আরোহণ করে গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি বখতিয়ার খলজি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলার মুসলিম রাজ্যকে শক্তিশালী, সুদৃঢ় ও সুসংঘবন্ধ করার প্রয়াস পান।
যদিও দেবকোট বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে মুক্ত ছিল। তথাপি লখনৌতিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
লখনৌতিতে রাজধানী স্থানান্তর করার সুবিধা হলো- লখনৌতি নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য সুবিধা হয়েছিল। লখনৌতি থেকে বঙ্গ ও বিহারের সাথে যোগাযোগ করা সহজ ছিল।
২. মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা : ইওজ খলজি প্রজাহিতৈষী শাসন ছিলেন। মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ রচিত তবাকাত-ই-নাসিরী' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ইওজ খলজি মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার সুবিধার্থে আলেম, সৈয়দ ও সুফিদের পৃষ্ঠপোষকরা দান করেন।
বাংলায় ইসলাম প্রচারের ধারক হিসেবে মনে করে তিনি এসব ধর্মপরায়ণদের ভরণ-পোষণ ও জায়গিরেরর ব্যবস্থা করেন।
সুলতানের এসব কর্মকাণ্ডে বাংলায় মুসলিম আলেম ও সুফি সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
৩. উড়িষ্যা বিজয় : উড়িষ্যার সাথে সংঘর্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। তৃতীয় রাজ অনঙ্গতীমের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ চট্টেশ্বর শিলালিপি, মিনহাজ-এর তবকাতে-ই-নাসিরী থেকে।
উভয় সূত্র থেকে তার উড়িষ্যা বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায় কিন্তু কোনো সূত্রেই বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না।
৪. হুিত বিজয় : গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির ত্রিহুত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায় মিনহাজ উদ্দিনের বর্ণনায়। কিন্তু অন্য কোনো সূত্রে ত্রিহুত অভিযানের কথা পাওয়া যায় না। তবে অবস্থার বিশ্লেষণ করলে ইওজের সাফল্য খুব একটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
৫. কামরূপ জয় : কামরূপ বিজয়ের বর্ণনা মিনহাজের বর্ণনায় পাওয়া যায়। মিনহাজের মতে, কামরূপের রাজা ইওজ খলজিকে কর প্রদানে বাধ্য হন।
করতোয়া নদীর পূর্বে অবস্থিত কামরূপ রাজ্যের অনেকগুলো সামন্তরাজনের অস্তিত্ব ছিল এবং তারা সকলে বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো এক সামন্ত রাজকে পরাজিত করে তাকে কর প্রদানে বাধ্য করে।
৬. দক্ষিণ পূর্ব বাংলা বিজয় : ইওজ বাংলার পশ্চিমাংশে রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে রাজা শাসন করেন। তিনি পূর্বাঞ্চলে তীয় প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন কিনা এ ব্যাপারে সঠিকভাবে জানা যায় না।
তবে তিনি সর্বপ্রথম নৌবহর গঠন করে তার সাহায্যে ১২২৬-২৭ সালে দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গে এক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন।
৭. বঙ্গবিজয় : দক্ষিণ পূর্ব বাংলা বিজয় করে গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির বঙ্গ বিজয় করেন। মিনহাজের মতে, লক্ষণ সেনের পুত্র সেন যখন রাজার ভয়ে ভীত হয়ে আতগ্রস্ত থাকত এবং এক পর্যায়ে গৌড় ত্যাগ করে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন।
৮. নৌবাহিনী গঠন : সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির বাংলার মুসলিম শাসনদের মধ্য তিনি প্রথম নৌবাহিনী গঠন করেন। নব প্রতিষ্ঠিত রাজধানী লখনৌতি নদীর তীরে হওয়ায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
অন্য দিকে তার ছিল রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা, তিনি জানতেন কেবলমাত্র তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা নদীমাতৃক বাংলা বিজয় সম্ভব নয় তাই বাংলা বিজয় করার মানসে এবং লখনৌতির প্রতিপত্তি রক্ষার্থে শক্তিশালী নৌবহর গঠন করেন এবং বাংলা নাবিকদের সাহায্যে নৌবহর চালাবার ব্যবস্থা করেন।
৯. মহাসড়ক নির্মাণ : সামরিক কারণে ও প্রজাদের মঙ্গলের জন্য রাজধানীর লখনৌতির সাথে উত্তর দেবকোট ও দক্ষিণ লখনৌতির সাথে দুই সীমান্তবর্তী শহরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য একটি দীর্ঘ রাজপথ বা মহাসড়ক নির্মাণ করেন।
এ রাজপথটি যেমন একদিকে সৈন্য চলাচলের সুবিধা করেছিল তেমনি অন্য দিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিও ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা করেছিল।
→ ইলতুৎমিশের সাথে সংঘর্ষ : ক্ষমতা লাভ করার পর কতিপয় কারণে ইলতুৎমিশ ও গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। নিম্নে গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির সাথে সুলতান ইলতুৎমিশের সংঘর্ষের বিবরণ নেওয়া হলো :
১. নিম্নি ও গৌড় নিয়ে সংঘর্ষ : দিল্লি ও গৌড়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকায় বখতিয়ারের সময় থেকে গৌড়ের আধিপতিগণ স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।
মাঝখানে খলজি মালিকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে কুতুবউদ্দিন গৌড় দখল করলেও তার মৃত্যুতে তা হাতছাড়া হয়ে যায়।
২. মুদ্রা প্রচলন নিয়ে বিবাদ : কুতুবউদ্দিনের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে ইলতুৎমিশ মনে করতেন, বাংলার স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রমাণ ছিল নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন। আর এতে করে প্রমাণ হয় যে তিনি বাংলার প্রথম সুলতান যিনি নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেন।
৩. সংঘর্ষের চূড়ান্ত পর্যায় : ১২২৫ সালে ইলতুতমিশ বাংলার অভিযান করেন। ইওজের বাহিনীর সাথে তার সঙ্গে বাঁধে বিহারের তেলিয়াপড় গিরিপথের কাছে বিপুল পরিমাণ রণতরী ও পদাতিক রণভীর সাথে সৈন্য নিয়ে ই যুদ্ধে ি হন।
কিন্তু সমসাময়িক ফলাফল নির্বিকার। যা হোক ধারণা লা হয় ইওজা দিল্লির বাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করেন, ১০ লক্ষ টাকার সম্পদ, ৩৮টি দিয়ে সন্ধি স্থাপন করেন।
৪. যোগ্য শাসক : গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি একজন সন্ত শাসক ছিলেন তার সুশাসনে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ন্যায়বিচার ও প্রজাহিতৈষী ছিলেন।
শাসক হিসেবে তার অবনম ভারতবর্ষের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তার শাসনব্যবস্থায় সকলের সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল। এর ফলে রাজ্যে শান্তি ফিরে আসে।
৫. দক্ষ কূটনীতিবিদ : গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি একজন উঁচুমানের কূটনীতিবিদ ও দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন।
কায়েমাজ কর্মীর কাছে তার আত্মসমর্পণ এবং পরবর্তীকালে আলীয়দান খলজির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর এ পদক্ষেপগুলো তার কূটনৈতিক জ্ঞান ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সে সময় তার শক্তি নিয়ে তাকে বাধা দিলে সুবিধা হবে না।
৬ মুদ্রা প্রচলন : মুলমান শাসকদের মধ্যে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি প্রথম সুলতান যার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে তার মুদ্রায় বাগদাদের খলিফার নাম অংকন এবং নাসিরুল ইমরুল মুমেনীন ও কশিম আমিরুল মুমেনীন উপাধির ব্যবহার হতে আবার অনেকে মনে করেন, গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি নিজ শক্তি দৃঢ় করার উদ্দেশ্য বাগদাদের খলিফার নিকট হতে সনদ লাভ করেছিলেন।
৭. স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক : গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি তার সময়ে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ মেরামত করেন। যা তার স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার পরিচয় বহন করে।
৮. শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক : গিয়াস উদ্দিন ইলে খলজি শিল্প ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি আলেম, সৈয়দ ও সুফীদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাদের ভরণপোষণের জন্য জায়গির ও বৃত্তি ব্যবস্থা করেন।
তার শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে সাম্রাজ্যে অনেক জ্ঞানী- বিদ্বান ব্যক্তিদের নগরে পরিণত হয়। তিনি বিশেষ করে সুফীদের বেশি সমাদর করতেন। ফলে সাম্রাজ্যে ইসলাম প্রচার সুবিধা হয়।
৯. ইসলাম প্রচারে কৃতিত্ব : মুসলিম সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এবং মুসলিম সাম্রাজ্যে উন্নতির জন্য তিনি মাদ্রাসা, মসলিন, খানকাহ নির্মাণ করেন। তার শাসন আমলে মধ্য এশিয়া থেকে অনেক মুঘলমান পণ্ডিত ও সুফি বাংলায় আসেন। এসব সুখি- পণ্ডিতগণ বাংলায় আসার জন্য সহায়তা করে।
১০. আব্বাসীয় খলিফার স্বীকৃতি লাভ : গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি আব্বাসীয় খলিফার নিকট থেকে সনদ বা স্বীকৃতি পত্র লাভ করেন। গিয়াসউদ্দিনের আমলের প্রচুর পরিমাণ মুদ্রা পাওয়া গেছে।
তার মধ্যে কয়েকটিতে খলিফার নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। আব্বাসীয় খলিফার নাম তিনি স্বীয় মুদ্রায় অঙ্কিত করেন। গিয়াসউদ্দিন আব্বাসীয় খলিফার নিকট প্রচুর মূল্যবান উপঢৌকণও পাঠান।
প্রতিদান হিসেবে বাগদাদের খলিফা তাকে আল-নাসির উপাধি প্রদান করে খিলাত (রাজভূষণ) ও ফরমান প্রেরণ করেন। বাংলায় নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য বাগদাদের খলিফার স্বীকৃতির যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, খিলজি শাসকদের মধ্যে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খিলজি ছিলেন অন্যতম। তিনি অতি সামান্য অবস্থা থেকে স্বীয় বুদ্ধি, সাহস ও কূটনৈতিক জ্ঞানের সাহায্যে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তার রাজ্য শাসন নিঃসন্দেহে ইতিহাস তথা ইসলামের ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি একজন সুদক্ষ শাসন ছিলেন।
তিনি বাংলার শিশু মুসলিম রাজ্যে অন্তর্বিরোধের অবসান ঘটিয়ে সুষ্ঠু শাসন প্রবর্তন করে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই বাংলার মানুষ বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায় ইওজ খলজিকে আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।