সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের কৃতিত্ব উল্লেখ কর
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের কৃতিত্ব উল্লেখ কর |
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের কৃতিত্ব উল্লেখ কর
- অথবা, গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ'র কৃতিত্ব সম্পর্কে কি জান লিখ।
- অথবা, গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ কৃতিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাও ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার স্বাধীন সালতানাদের ইতিহাস বিকাশে সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ ছিলেন এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বিদ্যোৎসাহী ও ন্যায়বিচারক শাসক হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেন।
লোকরঞ্জক ব্যক্তিত্ব এবং কর্মদক্ষতা তাকে সৌকর্যমণ্ডিত করে তুলেছিল। তাই তার রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে স্ম। গীয় হয়ে আছে।
- গিয়াসুদ্দিন আম শাহ'র কৃতিত্ব : নিম্নে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের কৃতিত্ব উল্লেখ করা হলো--
১. ক্ষমতা গ্রহণ : সিকান্দার শাহের নিহত হওয়ার পর গিয়াসুদ্দিন ‘আজম শাহ' উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি সুযোগ্য ও দক্ষ শাসক ছিলেন এবং প্রজাবৎসল | নৃপতি হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
২. ক্ষমতা সুদৃঢ়ীকরণ : স্বীয় ক্ষমতা সুদৃঢ়ীকরণের লক্ষ্যে প্রথমেই গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ তার বৈমাত্রেয় ভাইদের বন্দি করে তাদের চোখ তুলে ফেলার নির্দেশ দেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের হত্যা করেন। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি তাদের চক্ষু উৎপাটন করেই ছেড়ে দেন।
৩. রাজ্য বিস্তার : সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ কামরূপ আক্রমণ করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। আসাম বুরঞ্জীতেও গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ কর্তৃক আসাম অভিযানের ইতিহাস পাওয়া যায়। তিনি অহোমরাজ সুধাঙ ফা কামতা রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন।
৪. কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন : সুলতান আজম শাহ বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি প্রথমে আরব দেশ ও পারস্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
জৌনপুরের সুলতান খাজা জাহানের সাথেও তার মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। পিয়াসুদ্দিন আজম শাহ চীন সম্রাটের সাথেও দূত বিনিময় করেন।
চৈনিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ ১৪০৫, ১৪০৮ এবং ১৪০৯ খ্রিষ্টাব্দে চীন সম্রাটের নিকট দূত ও উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন।
৫. শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা : বিজেতা হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করতে না পারলেও শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ বাংলার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন।
তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর 'ইউসুফ জুলেখা' রচনা করেন। তিনি নিজে বিধান ছিলেন এবং ফারসি ভাষায় সুন্দর কবিতা লিখতে পারতেন।
৫. স্থাপত্যশিল্পে অবদান : ইবনে হার, আল-সাখাবী, গোলাম আলী আলাপ বিলগ্রামী প্রমুখ ঐতিহাসিকের বর্ণনায় দেখা যায় যে, গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ প্রচুর অর্থ ব্যয়ে মক্কা ও মদিনা শহরে মাদরাসা ও সরাইখানা স্থাপন এবং খাল খনন করেন।
এ দুই শহরের অধিবাসীদের মধ্যে বন্টন করার জন্য তিনি বহু অর্থও প্রেরণ করেন। বাংলার বিভিন্ন স্থানেও তিনি মাদ্রাসা, মসজিদ ও খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার সমসাময়িক সুফি নূর কুতুবুল আলমের সমাধি নির্মাণ করেন।
৭. বিদেশে দূত প্রেরণ : বিদেশে দূত প্রেরণ গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের রাজত্বের একটি অভিনব ও প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য। আজম শাহ পারস্যের কবি হাফিজ এবং মক্কা ও মদিনায় দূত পাঠিয়েছিলেন। এছাড়াও অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তিনি দূত পাঠিয়েছিলেন।
৮. প্রজারঞ্জক শাসক : সামরিক দিক থেকে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় না দিতে পারলেও গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ সুদক্ষ শাসক ও ন্যায়বিচারক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
প্রজারঞ্জক শাসক হিসেবে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। চরিত্রে নানা গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি বিদ্যোৎসাহী ও ধর্মনিষ্ঠ সুলতান ছিলেন।
এ দেশের হিন্দু ও মুঘলমান প্রজাদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সমঝোতা রক্ষায় তিনি যথেষ্ট অবদান রাখেন। গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ ন্যায়বিচারক ছিলেন।
তাঁর ন্যায়বিচারের কাহিনি কিংবদন্তী হয়ে আছে। সুলতান হয়েও তিনি সাধারণ লোকের মত বিচারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন।
একবার সুলতান স্বয়ং আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচার ও বিচারকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁর বিচারে উচ্চ-নীচ কোনো ভেদাভেদ ছিল না।
তাঁর সুশাসনে রাজ্যে সর্বদা সুখ-শান্তি বিরাজ করতো। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের লোকেরাই ছিল তাঁর চোখে সমান।
তিনি দীর্ঘ কুড়ি বছর সগৌরবে রাজত্ব করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে অবদান রেখে গেছেন।
৯. মাহুয়ানের বিবরণ : চৈনিক পর্যটক মাহুয়ানের বিবরণে বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার যে চিত্র পাওয়া যায় তা মূলত সমাজের উচ্চশ্রেণি ভিত্তিক।
তবে বাংলার প্রাচুর্য যে বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । পনের শতকে বাংলার অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান চৈনিক বিবরণের উপরই নির্ভরশীল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার ইতিহাসে সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের নাম সমুজ্জ্বল। তিনি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সুন্দর চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।
তার চরিত্রে নানারকম বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছিল। যার প্রত্যেকটিতেই একটি উন্নত ও বৈচিত্র্যময় মানব মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর রাজত্ব করার পর ১৪১১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গণেশ নামে একজন জমিদারের চক্রান্তে তাকে প্রাণ দিতে হয়।