সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালের বিবরণ দাও
সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালের বিবরণ দাও |
সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালের বিবরণ দাও
- অথবা, সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকাল উল্লেখ কর।
উত্তর : ভূমিকা : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ছিলেন বাংলার সুলতান। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ১৩৩৮ সালে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। ফখরুদ্দিন রাজত্বকাল বাংলার স্বাধীন সালতানাত যুগের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
→ ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসনকাল : নিম্নে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকাল আলোচনা করা হলো-
১. কদর খান ও ইজ্জতউদ্দিনের নিকট ফখরুদ্দিনের পরাজয় : বাংলায় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের স্বাধীনতা খবর পেয়ে লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান ও সাতগাঁয়ের শাসনকর্তা ইজ্জতউদ্দিন মিলিতভাবে সোনারগাঁও আক্রমণ করেন।
সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ পরাজিত হয়ে সোনারগাঁও পরিত্যাগ করেন। কদর খান বহু ধন সম্পদ ও হাতি ঘোড়া হস্তগত করে সোনারগাঁয়ে অবস্থান করেন।
ইজ্জতউদ্দিন নিজ শাসন কেন্দ্রে গিয়েছিলেন কি না তা সঠিক জানা যায়নি। কদর খান একসাথে লখনৌতি ও সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
২. কদর খানের পতন : কদর খান অত্যন্ত লোভী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সোনারগাঁও দখল করে প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেন এবং লুণ্ঠিত সম্পদের ভাগ কাউকে না দিয়ে একাই আত্মসাতের চেষ্টা করেন।
এতে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত সৈন্যদের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই অসন্তোষের সুযোগে ফখরুদ্দিন কদর খানের সৈন্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
ফলে অনেক সৈন্য কদর খানের পক্ষ ত্যাগ করে ফখরুদ্দিনের দলে যোগদান করে। এসময় কদর খান ও ফখরুদ্দিনের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
উভয় বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কদর খান পরাজিত ও নিহত হন। ফখরুদ্দিন সোনারগাঁও পুনরুদ্ধার করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।
৩. লখনৌতি অভিযান : কদর খানের মৃত্যুর পর লখনৌতি তার সেনাপতি আলী মুবারক সুলতান আলা উদ্দিন আলী শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
ফখরুদ্দিন লখনৌতি অধিকার করার জন্য মুখলিস নামক তার এক সেনাপতিকে পাঠান। কিন্তু মুবারক শাহ তাকে পরাজিত করেন।
লখনৌতি অধিকারে ফখরুদ্দিনের ব্যর্থতা আলী মুবারকের নিকট তার সেনাপতি মুখলিস খানের পরাজয় ও মৃত্যু উভয়ের মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষের সূচনা করে।
দুই নরপতি সমগ্র বাংলার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যকার সংঘর্ষ ছিল উভয়ের জন্য একদিকে আক্রমণাত্মক ও অপরদিকে প্রতিরোধ প্রকৃতির।
ফখরুদ্দিন উন্নততর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও শক্তিশালী নৌবাহিনী নিয়ে বর্ষা মৌসুমে প্রায়শ লখনৌতিতে আক্রমণ চালাতেন এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রতিহত করতেন।
আর তার চেয়ে উন্নতর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে আলী মুবারক শাহ আক্রমণ করতেন। উভয়ের মধ্যে প্রতিবছর সংঘর্ষ হতো। কিন্তু কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারেনি।
৪. ত্রিপুরা অভিযান : সুলতান ফখরুদ্দিন তার রাজত্বকালে যেসব অভিযান পরিচালনা করেন তার মধ্যে অন্যতম হলো ত্রিপুরা অভিযান।
তিনি ১৩৪০ সালে ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করেন। ত্রিপুরার রাজা প্রতাপ মানিক্যে ও তার মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধে।
উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হলে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং ত্রিপুরা রাজা প্রতাপ মানিক্যে পরাজয় বরণ করেন।
৫. চট্টগ্রাম বিজয় : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ত্রিপুরা জয়ের পর চট্টগ্রাম জয়ের পরিকল্পনা করেন। তিনি চট্টগ্রাম অধিকারের উদ্দেশ্য নোয়াখালীর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন।
চট্টগ্রাম তখন ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে ছিল। ফখরুদ্দিন চাটগাও দুর্গের বিপরীতে কর্ণফুলীর অপর পারে একটি সুউচ্চ ও দুর্ভেদ্য দুর্গ দখল করেন।
খুব সম্ভবত ১৩৪০ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করেন। তিনি চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ফখরুদ্দিন মুবারক বাংলার স্বাধীন সালতানাত যুগের সূত্রপাত করেন তা প্রায় ২ বছর স্থায়িত্ব লাভ করেছিল।
বাংলার ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন সুলতান হিসেবে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ স্মরণীয় হয়ে আছেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ১৩৩৮-১৩৪৯ সাল পর্যন্ত স্বাধীনভাবে সোনারগাঁও এর রাজত্ব পরিচালনা করেন।