সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর
সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর |
সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর
- অথবা, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পরিচয় পূর্বক তার রাজত্বকাল সম্পর্কে বর্ণনা দাও ।
- অথবা, আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকালকে বাংলার ইতিহাসে 'স্বর্ণযুগ' বলা হয় কেন?
উত্তর : ভূমিকা : হুসেন শাহী বংশের শাসন বাংলার স্বাধীন সালতানাতের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আলাউদ্দিন হুসেন শাহ হাবশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলায় শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনে সচেষ্ট হন।
এ বংশের সর্বমোট চারজন শাসক দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাদের রাজত্বকালে বাংলার প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। বিশেষ করে আলাউদ্দিন হুসেন শাহীর রাজত্বকালকে বাংলার স্বাধীন সালতানাতের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পরিচয় : আলাউদ্দিন হুসেন শাহের বংশ পরিচয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সৈয়দ বংশের লোক ছিলেন।
তার পিতা সৈয়দ আশরাফ-আল- হোসেনী তাকে ও তার ভাই ইউসুফকে নিয়ে তুর্কিস্থানের তারমুডা শহর থেকে সুলতান বরবক শাহের আমলে বাংলায় আসেন এবং চাকরি গ্রহণ করেন।
ঐতিহাসিকগণ এ কথা স্বীকার করেন যে, হুসেন শাহ সিংহাসন লাভের আগেই বাংলায় অবস্থান করছিলেন।
ফিরিশতা ও গোলাম হুসেন সলীমের মতে, তিনি হাবশী সুলতান শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহের উজির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং যথেষ্ট ক্ষমতাশালী ছিলেন।
রিয়াজ-উস-সালাতীনের বর্ণনা অনুযায়ী হুসেন শাহ রাঢ়অঞ্চলের কাজীর প্রভাবে সরাসরি সুলতান মুজাফফর শাহের অধীনে উজির পদ লাভ করেন।
ক্ষমতাগ্রহণ : হুসেন শাহ বিচক্ষণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন সুলতান মুখাফফর শাহের অত্যাচার, অনাচার এবং দুঃশাসনের ফলে সমগ্র দেশে অসন্তোষের অগ্নি প্রবলিত হয়।
সিংহাসন নিয়ে বিবাদ, ষড়যন্ত্র, হত্যা প্রভৃতি কারণে বিশৃঙ্খলা যখন চরমে তখন তার বুদ্ধিমান মন্ত্রী হুসেন শাহ বিদ্রোহী সৈন্যবাহিনী এবং অন্যান্য রাজকর্মচারীদের সহায়তায় বাংলায় হাবশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৪৯৩ সালে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেন।
সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি হাবশী আমলের কুশাসন দূর করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হন।
- সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকাল : হুসেন শাহী বংশের মোট চারজন সুলতান বাংলায় রাজত্ব করেন। তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। তার রাজত্বকালে বাংলার সর্বত্র উন্নতি পরিলক্ষিত হয়।
নিম্নে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকাল আলোচনা করা হলো :
১. অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা : সিংহাসনে আরোহণ করে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনে উদ্যোগী হন। ক্ষমতা লাভের পর তিনি হাবশী আমলে অরাজকতা সৃষ্টিকারী পাইকদের নিরস্ত্র ও চাকরিচ্যুত করেন।
পাইকলের স্থলে তিনি নতুন এক বাহিনী গঠন করেন। তিনি দেশকে হাবণী প্রভাবমুক্ত করার জন্য রাজ্য থেকে তাদের তাড়িয়ে দেন।
রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অভিজ্ঞ রাজা-কর্মচারী নিয়োগ করে রাজ্যের বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এভাবে তিনি দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সুশাসনে পথ সুগম করেন।
২. রাজধানী স্থানান্তর : বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে রাজধানী রক্ষা এবং শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহ পান্ডুয়া থেকে তেইশ মাইল উত্তর-পূর্বে একডালায়, রাজধানী স্থানান্তর করেন। রাজধানী স্থানান্তর সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে।
৩. রাজ্যবিস্তার : অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর আলাউদ্দিন হুসেন শাহ রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৪৯৫ সালে বিহার জয় করেন।
অতঃপর তিনি কামতা ও কামরূপ জয় করে স্বীয় রাজ্যভুক্ত করেন। ত্রিপুরা রাজ্যজয়ের জন্য তিনি পর পর চারটি অভিযান প্রেরণ করেন।
তাছাড়া ১৫০৯ সালে তিনি আরাকান রাজাকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। এভাবে তিনি বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যাব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
তার সামরিক অভিযান সম্পর্কে ড.এ. বি.এস. হাবিবুল্লাহ বলেন, “তার রাজত্বকালে বঙ্গদেশের সীমা পশ্চিমে সরণ ও বিহার দক্ষিণ- পশ্চিমে মান্দারণ ও চব্বিশ পরগনা, উত্তর-পশ্চিমে হাজো এবং দক্ষিণ-পূর্বে শ্রীহট্ট ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।” নিম্নে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
৪. কামতা-কামরূপ অভিযান : বাংলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে | কাযতা ও কামরূপের সাথে বাংলার সুলতানদের প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহও কামতা ও কামরূপে অভিযান প্রেরণ করেন এবং এই অভিযান সফলও হয়।
রিয়াজ- উস-সালাতীন গ্রন্থ মতে, হুসেন শাহ অসংখ্য পদাতিক সৈন্য ও যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে ঐ রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। তিনি ইঞ্জিত রাজ্য থেকে বিস্তর ধনসম্পদ সংগ্রহ করেন।
হুসেন শাহ বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ তার ছেলে দানিয়েলকে বিজিত রাজ্যে শালা স্থাপনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত রেখে নিজে বিজয়ীর বেশে বাংলায় ফিরে আসেন।
৫. আসাম অভিযান : আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামরূপ ও কামতা জয় করে আসামে অভিযান প্রেরণ করেন। হুসেন শাহের তবে আসামের রাজা রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান।
তখন হুসেন শাহ বিরাট সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বে তার ছেলেকে রেখে নিজে গৌরবের বেশে স্বদেশে ফিরে আসেন।
কিন্তু বর্ষাকালে সুযোগ বুঝে আসামের রাজা বাংলার বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে দেয়। এভাবে কামরূপ ও কামতা হুসেন শাহের অধীনে থাকলেও আসাম হাত ছাড়া হয়ে যায়।
৬. উড়িষ্যা অভিযান : আলাউদ্দিন হুসেন শাহের উড়িষ্যা অভিযানের বিস্তৃত বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না । ষোল শতকের পর্তুগিজ ভ্রমণকারী ডুয়ার্ট বারবোসা লিখেছেন, বাংলা ও উড়িষ্যার মধ্যে কোনো কোনো সময় যুদ্ধ লেগে থাকত।
রিয়াজ ও বুকাননের পাণ্ডুলিপি এবং সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বৃন্দাবন দাসের লেখনীতে এই সংঘর্ষের উল্লেখ পাওয়া যায় উড়িষ্যার মাদলা পঞ্জিকায় ১৫০৯ সালে উড়িষ্যা গৌড়ীয় মুসলিম সেনা কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।
সমসাময়িক উড়িষ্যারাজ প্রতাপ রুদ্রদেব প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। ১৫১০ সালে তার রাজত্বকালের এক লিপিতে মুসলিম রাজ কর্তৃক হতরাজ্যের পুনরুদ্ধারের উল্লেখ হুসেন শাহের আক্রমণের কলাই প্রমাণ করে।
তবে হুসেন শাহের সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। তবে ক্ষণস্থায়ী সাফল্য যে হয়েছিল সে বিষয়ে তেমন কোনো সন্দেহ নেই।
৭. ত্রিপুরা অভিযান : আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ত্রিপুরা অভিযান সম্পর্কে তার নিজের শিলালিপি ও ত্রিপুরা রাজমালার তথ্যে পাওয়া যায়। শিলালিপির সাক্ষ্য মতে, হুসেন শাহ ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তত কিছু অংশ জয় করেছিলেন।
রবীন্দ্র পরমেশ্বর তার মহাভারতে হুসেন শাহের অন্যতম সেনাপতি ছুটি খান ত্রিপুরার "বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। রাজমালায় হুসেন শাহ ও ত্রিপুরারাজ ধন্যমাণিক্যের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের উল্লেখ পাওয়া যায়।
৮. চট্টগ্রাম বিজয় : রাজমালা থেকে জানা যায়, ত্রিপুরারাজ ও আরাকানরাজ কিছু সময়ের জন্য চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।
তবে চট্টগ্রাম যে, স্থায়ীভাবে হুসেন শাহের অধিকার এসেছিল তার বহু প্রমাণ সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য ও অন্যান্য গ্রন্থে রয়েছে।
সুতরাং মনে হয় যে, চট্টগ্রাম অধিকারকে কেন্দ্র করে হুসেন শাহের সাথে ত্রিপুরা ও আরাকানের রাজাদের চট্টগ্রামের উপর অধিকার খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল এবং ১৫১৭- "১৫৩৮ সালে চট্টগ্রামের উপর হুসেন শাহী শাসকদের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল।
হুসেন শাহের পুত্র নসরত শাহ এবং খুব সম্ভবত পরবর্তীকালে পরাগল খান তার পুত্র ছুটি খান আরাকানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেন।
৯. পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা বিধান : হুসেন শাহ যখন অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন কাজে ব্যস্ত তখন বাংলার পশ্চিম সীমান্তে শর্কি-লোদী সংঘৰ্ষ তীর হয়ে উঠে।
সিকান্দার লোদী জৌনপুরের সুলতান হোসেন শর্কিকে পরাজিত করে জৌনপুর দখল করলে হোসেন শর্কি বাংলার সুলতান হুসেন শাহের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
পশ্চিম সীমান্তে গোপী সাম্রাজ্যের বিস্তার স্বভাবতই বাংলার সুলতানের আশঙ্কার কারণ হয়। হোসেন শর্কিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সিকান্দার লোদী বাংলার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
অবশেষে উভয়পক্ষে শান্তি স্থাপিত হয়। এর ফলে উত্তর বিহার বাংলার শাসনাধীন হয়। এভাবে হুসেন শাহ পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা বিধান করেন।
১০. বীরযোদ্ধা ও সুশাসক : সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ একজন বীরযোদ্ধা ছিলেন। দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদী কর্তৃক তার পশ্চিম সীমান্ত আক্রান্ত হলে তিনি এর উপযুক্ত প্রতিবিধান করেন।
ফলে সিকান্দার লোদী সন্ধি করতে বাধ্য হন। তাছাড়া আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন একাধারে সুলক্ষ সৈনিক অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং প্রজারঞ্জক শাসক। তিনি বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতানদের অন্যতম ছিলেন।
১১. পরধর্মসহিষ্ণু : আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন উদার, বিচক্ষণ ও পরধর্মসহিষ্ণু তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুখলমান ছিলেন।
বলা হয় যে, বিগত দুইশ বছরে বাংলায় যত মসজিদ নির্মিত হয় তা অপেক্ষা অধিক সংখ্যক মসজিদ হুসেন শাহের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছে। তিনি মুঘলমান সুফি ও দরবেশদের অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন।
অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেবকে তিনি সম্মানের চোখে দেখতেন। তার সময়ে শ্রীচৈতন্য নির্বিবাদে তার ধর্মমত প্রচার করতেন।
১২. হিন্দুদের প্রতি উদারনীতি : সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ শাসন ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করেন। হিন্দু ও মুসলিমদের তিনি সমান চোখে দেখতেন এবং যোগ্যতানুসারেই সব সম্প্রদায়ের লোককে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করতেন।
তার রাজত্বকালে অনেক হিন্দু উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত হন। নিম্নপদেও অনেক হিন্দু কর্মচারী ছিল। তার উদারতায় মুগ্ধ হয়ে হিন্দুরা তাকে 'নৃপতি তিলক', 'জগৎভূষণ' প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৩, জনহিতকর কার্যাবলি : আলাউদ্দিন হুসেন শাহ একজন দয়ালু ও প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি দেশের উন্নতির কথা ভাবতেন এবং প্রজাদের কল্যাণের জন্য জনহিতকর প্রতিষ্ঠান নির্মাণে তৎপর ছিলেন।
তিনি গরীব-দুঃখীদের উপকারের জন্য অনেক লঙ্গরখানা স্থাপন করেন। তিনি সৈন্যদল ও জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার জন্য দেশে অনেক রাস্তা নির্মাণ করেন। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কূপও খনন করেন।
১৪. স্থাপত্য নিদর্শন : আলাউদ্দিন হুসেন শাহ শিল্পানুরাগীও ছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদান আছে। ইলিয়াসশাহী আমলে স্থাপত্যশিল্পে যে নতুন রীতির সৃষ্টি হয়েছিল তা তার শাসনকালেও অক্ষুণ্ণ ছিল।
তার রাজত্বকালে নির্মিত মসজিদ সমূহের মধ্যে গৌড়ের 'ছোট সোনা মসজিন' এবং 'তমতি দ্বার' আজও শিল্প সৌন্দর্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।
তার সমাধি সৌধও শিল্পকর্মের এক অপূর্ব নিদর্শন ছিল। এছাড়া তিনি মাদরাসা, সরাইখানা ইত্যাদি নির্মাণ করেন।
১৫. শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা : আলাউদ্দিন হুসেন শাহ শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন।
তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে সৈয়দ মীর আলাবী "হিদায়ত আল রুমী' নামক একটি ফারসী গ্রন্থ রচনা করেন এবং তা সুলতানের নামে উৎসর্গ করেন। সুলতান সাহিত্যনুরাগীও ছিলেন।
তিনি আরবি ও ফারসি সাহিত্যের, বাংলা সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি বাংলা ভাষাকে সরবারে স্থান দেন এবং তার শাসনামলেই বাংলা ভাষার উন্নতির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সৃষ্টি হয়।
তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত হয়। রূপ গোস্বামী সুলতানের উৎসাহে বিদগ্ধমাধর ও 'ললিত মাধব' নামে দুটি বই লেখেন।
মালাধর বসু সুলতানের উৎসাহ ও সাহায্য নিয়ে 'শ্রীমত্ৰাগৰত' বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সাহিত্যপ্রীতি তাঁর অধীনস্থ রাজ কর্মচারীদেরকেও অনুপ্রাণিত করে।
→ আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকালকে বাংলার ইতিহাসে "স্বর্ণযুগ" বলার কারণ : আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকালকে বাংলার ইতিহাসে 'স্বর্ণযুগ' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। কারণ এক চরম অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হুসেন শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তার সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে পরপর কয়েকজন সুলতান অল্পদিন মাত্র রাজত্ব করে আততায়ীর হাতে নিহত হন।
এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেও সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করেছিলেন, বহু রাজ্য জয় করে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছর এই বিশাল ভূখণ্ডে অপ্রতিহতভাবে রাজত্ব করেছিলেন ও জাদের মঙ্গলের জন্য অনেক জনহিতকর কাজ করেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ একজন প্রজাদরদি ও প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। ফ্রান্সিস বুকানন ভাই যথার্থই বলেছেন, “সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের চরিত্রে মহত্ত্বের অভাব ছিল না।
হুসেন শাহ নিষ্ঠাবান মুঘলমান হলেও হিন্দুদের প্রতি তিনি উদারনীতি পোষণ করতেন।” তার আমলে জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা উন্নত ছিল।
এসময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক নবদিগঞ্জের সূচনা হয়। সে সময়ের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে বুঝা যায় যে, সে যুগ সর্বক্ষেত্রে উন্নতির চরম শীর্ষে অবস্থান করেছিল।
সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা, ধর্মীয় উদারতা, জনহিতকর কার্যাবলি, স্থাপত্য ও সাহিত্যপ্রীতি ইত্যাদির জন্য তার রাজত্বকালকে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকাল নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গৌরবজনক অধ্যায়।
তিনি যথার্থই বাংলার মুঘলমান সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ মহৎ প্রকৃতির লোক ছিলেন।
তার শাসনামলে বাংলার সর্বত্র উন্নতির ছোঁয়া লাগে। তার রাজত্বকালে বাংলার প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
শিক্ষা-সংস্কৃতির তিনি একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার রাজ্যে সকল ধর্মের লোকের সমানাধিকার ছিল।