শিল্প সাহিত্যের বিকাশে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অবদান নিরূপণ কর
শিল্প সাহিত্যের বিকাশে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অবদান নিরূপণ কর |
শিল্প সাহিত্যের বিকাশে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অবদান নিরূপণ কর
- অথবা, শিল্প সাহিত্যের বিকাশ সাধনে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ভূমিকা বর্ণনা কর।
- অথবা, শিল্প সাহিত্যের বিকাশ সাধনে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের যে অবদান ফুটে উঠেছে তার বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পরিপুষ্টতায় হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৩-১৫৩৮) সুলতানদের অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রথম সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমল নানা বৈশিষ্ট্যে ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়ে আসছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ শাস্তি প্রতিষ্ঠায় জনগণের জীবনবোধে আস্থার সঞ্চার হয়েছিল। হিন্দু-মুঘলমানের পারস্পরিক সমঝোতার চূড়ান্ত ফলশ্রুতি তাঁরই আমলে দৃষ্টিগোচর হয়।
→ শিল্প সাহিত্য বিকাশে হুসেন শাহের অবদান : শিল্প-সাহিত্য বিকাশে হুসেন শাহের অবদান অপরিসীম। জীবনযাত্রায় যখন দুর্বিপাক তিরোহিত, ধর্মচর্চায় অবাধ অধিকার প্রতিষ্ঠিত তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি সাফল্যের প্রশস্ত যুগ-ক্ষেত্র রচিত হয়েছে।
হুসেন শাহের আমলেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কাব্যজগতে কেবল পুরাতন ধারার বিকাশ নয় নতুন উদ্ভাবনেও এ যুগের একটা স্বতন্ত্র মূল্য আছে।
নিম্নে শিল্পসাহিত্য বিকাশে হুসেন শাহের অবদান বর্ণনা করা হলো-
১. কবি-সাহিত্যিকদের উচ্চপদ দান : আলাউদ্দিন হুসেন শাহ তার রাজদরবারে কবি-সাহিত্যিকদের বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেন। তিনি তার রাজদরবারে কবি সাহিত্যিকদের উচ্চপদ দান করেন।
কবি সাহিত্যিকদেরকে তিনি সম্মান করতেন তা সেসময়ের সাহিত্য থেকেই আঁচ করা যায়। সমসাময়িক একাধিক কবি তাদের রচনায় হুসেন শাহের স্মৃতি রচনা করেছেন। এসময়ে 'কবি-সাহিত্যিকদের যশ ছড়িয়ে পড়েছিল।
২. বাংলা সাহিত্যের সাথে সংযোগ : উদার দৃষ্টি ও সমুচ্চ আদর্শ সমন্বিত যে ইসলামি শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতি হুসেন শাহ তাতে পরিপূর্ণ ছিলেন। তিনি জন্মের দিক থেকে আরবীয় বলা হলেও তিনি স্থানীয় এক বাঙালি নারীকে বিবাহ করেন।
ফলে তার সাথে বাংলার মূল অধিবাসীদের সাথে এক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হলো। এটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য ফলদায়ক হয়েছিল।
৩. প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুগ্রহ : সুলতানের সময়কার কবিগণ কেউ কেউ প্রত্যক্ষ অনুগ্রহ লাভ করলেও অনেকে পরোক্ষ অনুগ্রহও লাভ করেছিলেন।
কবিগণের মধ্যে বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস ও যশোরাজ খান হুসেন শাহের প্রত্যক্ষ অনুগ্রহ লাভ করতে পারেন।
অন্যদিকে কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকরনন্দী পরোক্ষভাবে গৌড়েশ্বরের সহানুভূতি লাভের দাবিদার ছিলেন।
তিনি কবি সাহিত্যিকদের খেতাবও দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। অনেকে মনে করেন যশোরাজ খান নাম নয়, উপাধি।
৪. উদারতার প্রভাব : হুসেন শাহ একটি উনার শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তার শাসন ক্ষেত্রে মেধার বিচারে নিয়োগ প্রদান করা হতো।
এ ব্যবস্থার মেধাবীরা মূল্যায়িত হতে থাকে ফলে সাহিত্যে পারদর্শী ব্যক্তিদের পক্ষে রাজার অনুগ্রহ লাভ করা কষ্টসাধ্য ছিল না। যারা প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য রচনার দক্ষ ছিল তারা সহজেই রাজকীয় অনুগ্রহ লাভ করে।
৫. স্থানীয় সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা : হুসেন শাহ স্থানীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। তিনি স্থানীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশকে ত্বরান্বিত করেন। স্থানীয় সাহিত্যকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি সগৌরবে বিকাশ লাভ করতে থাকে।
৬. হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা : হুসেন শাহ হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়। তার সময়ে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুদিত হতে থাকে।
পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অনুবাদ করেন। বিজয় গুপ্ত 'মনসামঙ্গল' কাব্য রচনা করেন। এছাড়া 'মনসা বিজয়' বৈষ্ণবপদ' প্রভৃতি গ্রন্থ এসময়ে রচিত হয়েছিল ।
৭. সমর বিজয়ের প্রভাব : আদিকবি রচিত 'মহাভারত' মহাকাব্য একখানি পুরোপুরি রাজকাহিনি। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, রাজ্যের উত্থান-পতন, পরক্রান্ত দুটি রাজশক্তির সংগ্রাম, সমরক্ষেত্র অসির ঝংকার আর বীরত্বের হুংকারে মহাকাব্যের প্রতিটি পাতা মুখরিত ও পরিপূরিত।
ত্রিপুরা ও আরাকানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ ও বিজয়ী হয়ে পরাগল খান ও ছুটি খান বীরত্বের গৌরব কাহিনি শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করবেন, তা অতি স্বাভাবিক। এ কারণেই মহাভারতের 'অশমেধ' পর্বের অনুবাদ করা হয়েছে।
৮. আদিকবি কঙ্ক ও সত্যপীরের কাহিনি : বিদ্যাসুন্দর কাহিনি'র আদি কবি কঙ্ক হুসেন শাহের আমলে আবির্ভূত হন। তার কাব্যের রচনাকাল আনুমানিক ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দ।
সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে কাব্যখানি রচিত হয়। একজন পীরের আদর্শে কবি তা রচনা করেন।
সুলতানের সুশাসনে জনগণের জীবনবোধে যে গভীর আস্থা সঞ্চারিত হয়েছিল, তাতে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশে নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল তা এ রচনা থেকে উপলব্ধি করা যায়।
৯. শ্রীচৈতন্য ও বৈষ্ণব ধর্ম : শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব এবং বৈষ্ণবধর্মের প্রচার হুসেন শাহের রাজত্বকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চৈতন্যদের ধর্মমত বাখ্যা ও প্রচারের মাধ্যমে হিসেবে বাংলা ভাষাকে বেছে নিয়েছিলেন।
বৌদ্ধধর্মের আশ্রয়ে এক সময় সর্বভারতীয় পালি ভাষা যে উন্নতি ও সংস্কৃতিক মর্যাদা লাভ করেছিল, বাংলা ভাষা ও এ সময়ে উৎকণ্ঠা ও গৌরব লাভ করেছিল। এক্ষেত্রে হুসেন শাহ শ্রী চৈতন্যের ধর্মমত প্রচারকে বাধামুক্ত করেছিলেন।
১০. ভিনদেশী কবি-সাহিত্যিকদের আশ্রয়দান : কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর বহু গ্রিক মনীষী ইউরোপের নানা স্থানে আশ্রয় গ্রহণ কর। ফলে ইউরোপে সাংস্কৃতিক রেনেসা এসেছিল।
হুসেন শাহ ও তার রাজ্যে পরাজিত রাজ্যের কবি-সাহিত্যিকদের স্থান প্রদান করেন। কুতবন ও যশোধর নামক দু'জন হিন্দি কবির পরিচয় পাওয়া যায়।
কুতবন হুসেন শাহ শাদীর সাথে এদেশে এসেছিলেন। কুতবনের গ্রন্থের নাম 'মৃগবতী'। রোমান্টিক প্রণয়কাহিনি এ কাব্যের বিষয়বস্তু।
বাংলার সীমান্তে ভাগলপুরে তিনি বসবাসের সুযোগ পান । তিনি হুসেন শাহের এবং তার দরবারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
১১. আরবি ও ফারসি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা : আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আদি জন্মভূমি আবর দেশে। এছাড়া 'ফারসি রাজভাষা ছিল। ফলে এসকল ভাষায়ও সাহিত্য রচনা হতে দেখা যায়।
মুহম্মদ বুদই-উর্ফ 'হিদয়ত অন্যায়ী' নামে ধমুবিদ্যা সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ লেখেন। গ্রন্থখানি হুসেন শাহের নামে উৎসর্গীকৃত।
মুহম্মদ বিন ইয়াজদান বক্স সহীহ আল বুখারী' গ্রন্থের তিন খণ্ডে অনুবাদ সমাপ্ত করেন। গ্রন্থখানি হুসেন শাহের রাজধানী এক ডালায় বসে লিখিত।
উপসংহার : উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়- বাংলা, সংস্কৃত, ব্রজবুলি, হিন্দি, আরবি, ফার্সী প্রভৃতি ভাষায় শাস্ত্রে ও সাহিত্য রচনা শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার সুলতান হুসেন শাহের আমলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
সুলতান স্বয়ং এসব ভাষায় দখল রাখতেন। তার সভাসদ, অনুগ্রহ প্রার্থী, কৃপাপ্রার্থী কবি পণ্ডিতেরা জ্ঞান, ধর্ম, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে সাধনা ও আলোচনা করে যে যুগের সাংস্কৃতিক জীবনের প্রভূত উন্নতি বিধান করেছিলেন।
হুসেন শাহের এ অবদানের কারণে বলা হয়- "Husain Shah was one of the most and perhaps, the most Important ruler in the history of Mediaval Bengal.” (মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসে হুসেন শাহ অন্যতম এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক।)