সেন শাসনামলে প্রাচীন বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লিখ
সেন শাসনামলে প্রাচীন বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লিখ |
সেন শাসনামলে প্রাচীন বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লিখ
- অথবা, সেন যুগে বাংলার সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও।
ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের বড় একটি অংশ দখল করে আছে সেন বংশ। পালবংশের রাজা মানসপালকে মতাচ্যুত করে সেন বংশের সেখানে সেন বংশের গোড়াপত্তন করেন।
প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে এবং সামাজিক উন্নতিতে সেন বংশের অবদান অন্যদের চেয়ে বেশি। তবে সেন বংশের শাসনামলে বাংলার সামাজিক নিয়মনীতিতে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়।
সেন আমলে বাংলার সামাজিক অবস্থা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার যতটুকু উন্নতি দেখা যায় তা পাওয়া যায় সেন বংশের রাজত্বকালে। সেন বংশের রাজত্বকালে বাংলার আর্থসামজিক অবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয়।
নিম্নে তা প্রশ্নালোকে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস : সেনদের পূর্বে পালবংশের সময়ে বাংলার হিন্দুধর্মের মধ্যে চারটি বর্ণ ছিল। সেটা পরবর্তিতে সেন বংশের রাজত্বকালের সময়ে এ বর্ণ প্রথা আরো সুদৃঢ় হয় 'এ চারটি বর্ণ হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
এ চারটি বর্ণের মধ্যে আর্থসামাজিক অবস্থায় ব্রাহ্মণরা ছিল সবার উপরে। সেন বংশের আমলে ব্রাহ্মণদের প্রভাব অনেক বেশি বেড়ে যায়। তারা অন্যান্য বর্ণের উপর নানা অন্যায়-অত্যাচার করা শুরু করে।
২. অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা : সেন যুগের সংস্কৃত সাহিত্য ও প্রাচীন সাহিত্যের নিদর্শন চর্চাপদ থেকে সেন যুগের বাংলার মানুষের সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায়। সেন যুগের বাংলার মানুষের এ সহজ-সরল জীবনকে চীনা পরিব্রাজক বয়সী প্রশংসা করেছেন।
৩. কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তক : সেন যুগের সমাজ ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো কৌলিন্য প্রথা। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন সমাজে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। এ কৌলিন্য প্রথা তৎকালীন সেন সমাজব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল।
৪. নারীদের অবস্থা : সেন যুগের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, সে সময় বাঙালি সমাজে নারীর স্থান ছিল খুব উচ্চে। বাৎসায়নের কামসূত্রে রমণীদের মৃদু শান্ত এবং সুন্দরী বলা হয়েছে।
বাৎসায়ন নারী সমাজে পর্দা প্রথার উল্লেখ করলেও তা মধ্যযুগের মতো খুব কঠোর ছিল না। আইনের চোখে মেয়েদের নিজস্ব স্বাধীনতা ছিল না তবে জীবনমৃতবাহন, পুত্রের অবর্তমানে স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর বৈধ অধিকার ছিল।
৫. সতীদাহ প্রথা : সেন যুগের সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল এবং তা ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। ঘৃণ্য প্রথা অনুসারে কোনো মহিলার স্বামী মৃত্যুবরণ করলে তাকে স্বামীর সাথে আত্মহুতি দিতে হতো।
৬. বহুবিবাহের প্রচলন : সেন যুগে সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। পুরুষরা ইচ্ছা করলে একাধিক বিবাহ করতে পারতো, স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু নারীরা বহু বিবাহ করতে পারতো না।
৭. খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদ : সেন যুগে বাংলার বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের প্রচলন ছিল সে সময় সমাজে দাবা ও পাশা খেলার বেশ জনপ্রিয় এছাড়া খেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কুস্তি, শিকার, নৌকা বাইচ ইত্যাদি। নারীদের উদ্যান রচনা, জলক্রীড়া প্রকৃতি আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থার ছিল সমাজে ।
৮. অলংকার : সেন যুগে প্রাচীন বাংলার সমাজ ব্যবস্থা নারী-পুরুষ নির্বিশেষ অলংকার ব্যবহার করতো। এ যুগে ব্যবহৃত অলংকার মধ্যে সোনা ও রূপার কেয়র, নাকফুল, মল উল্লেখযোগ্য ছিল।
এ অলংকারে সোনা ভিন্ন মূল্যবান পাথর হীরা, মুক্তা ইত্যাদি থাকতো। অর্থাৎ শহর ও গ্রামের মেয়েদের মধ্যে অলংকারেও ভিন্নতা ছিল।
৯. পূজা পার্বণ : সেন যুগেও বর্তমান কালের ন্যায় বারো মাসে তেরো পূজা ছাড়াও অন্নপ্রাশন, বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল।
পূজা পার্বণ উপলক্ষেও নাচ, গান এবং আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল সে সময়ও মাঘে শ্রীপঞ্চম, ফাল্গুনে দোল পূর্ণিমা ও বাসন্তী পূজা প্রচলিত ছিল।
১০. সামাজিক রীতিনীতি : সেন যুগে সামাজিক, রীতিনীতি ক্ষেত্রে বেশ কঠোরতা বজায় ছিল। এ সময় স্পৃশ্য, অসম্পৃশ্য প্রকৃতি সংস্কার সমাজের সাধারণ মানুষের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে।
‘বল্লাল চরিত' থেকে জানা যায় যে, রাজা ইচ্ছা করলেই যেকোনো শ্রেণিকে সমাজে উন্নত, অবনত করার ক্ষমতা রাখতেন। সমাজে প্রত্যেক সম্প্রদায় পেশা বা বৃত্তি পৃথক থাকলেও তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতো না ।
১১. সামাজিক অসম্প্রীতি : সেন যুগে বাংলার সামাজিক অসম্প্রীতি বহু গুণে বিস্তার লাভ করেছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার ও উৎপীড়নে সমাজ থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রায় বিলুপ্তি হয়েছিল তো বটেই, নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরাও ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন থেকে রক্ষা পেত না।
সেন যুগে এ সামাজিক অসম্প্রীতি ও বিশৃঙ্খলা পরবর্তীতে বাংলার ইসলাম ধর্ম বিস্তারের পথ সুগম করেছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সেন বংশের সুদীর্ঘ একশ বছরের রাজত্বকালে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও বেশ অগ্রগতি হয়।
কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনের ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও তা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি । প্রাচীন বাংলার সেন যুগে সামাজিক অগ্রগতি এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে।