রোহিতগিরি কি । ময়নামতির ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর

রোহিতগিরি কি । ময়নামতির ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর
রোহিতগিরি কি । ময়নামতির ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর

রোহিতগিরি কি । ময়নামতির ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর

  • অথবা, রোহিতগিরি সম্পর্কে যা জান লিখ। 
  • অথবা, রোহিতগিরি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার যে সকল এলাকায় সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল তার মধ্যে কুমিল্লায় ময়নামতি অন্যতম। আর এই ময়নামতিকে রোহিতগিরি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। 

এটি বাংলায় হিন্দু বৌদ্ধ শাসনামলে সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যময় একটি এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে বৌদ্ধদের ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি বিভিন্ন বিহার বৌদ্ধ মঠ ইত্যাদি পাওয়া গেছে। 

হিন্দু বৌদ্ধ শাসনের পতন ঘটলে ময়নামতি রাজ্যও বিলুপ্ত হয়ে যায় । পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার বাংলায় শাসন ক্ষমতা লাভের পর ময়নামতির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় এবং এখানে প্রাচীনকালের ধ্বংসাবশেষ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় ৷

১. ময়নামতির অবস্থান : ময়নামতি বা রোহিতাগিরি বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরের প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অনুচ্চ একটি পার্বত্য এলাকা। লালমাই অঞ্চলের প্রাচীনতম একটি সভ্যতার নিদর্শন হলো ময়ানামতি। 

বর্তমানে এখানে যে ধ্বংসস্তূপ পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাচীন নগরী ও বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এটি জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ।

অসংখ্য ঢিবি, স্মৃতিত্বঃ, খননকৃত ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য বিক্ষিপ্ত নিদর্শনসমূহ এখানকার ঘটনাবহুল অতীত ও গৌরবের প্রতি জোরালো ইঙ্গিত বহন করে। তবে এখানে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষসমূহের জন্যই ময়নামতি অধিক পরিচিত।

২. আবিষ্কার : ময়নামতি বা রোহিতগিরি প্রথম শনাক্ত করা হয় ১৮৭৫ সালে। পাহাড়গুলোর মধ্য দিয়ে প্রসারিত পুরনো সড়ক পুনর্নির্মাণকালে একটি বৌদ্ধ মঠ প্রথম চিহ্নিত হয়। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ময়নামতির ধ্বংসাবশেষসমূহ পুনরাবিষ্কৃত হয়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে জরিপের ফলে সমগ্র অঞ্চলের জনবসতিহীন এলাকা থেকে আরো পঞ্চাশের অধিক স্থান চিহ্নিত করা হয়। 

১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়। খনন পর্যায়ে পঞ্চাশোর্ধ স্থানের মধ্যে এ যাবৎ নয়টি উন্মোচিত হয়েছে। যদিও খনন কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।

৩. ময়নামতি বা রোহিতগিরির ইতিহাস : রোহিত গিরি বা ময়নামতি প্রাচীন বাংলার সমতট অংশ ছিল। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস ও দেশি-বিদেশি সাহিত্য থেকে সমতট অঞ্চল শাসনকারী বেশ কয়েকটি রাজবংশের নাম জানা যায়। 

যার অন্যতম হচ্ছে গুপ্ত, দেব, চন্দ্র, পালবংশ, বর্মন, সেন বংশ ও পরে মুসলিম শাসন এবং ১৮ শতকে ব্রিটিশ শাসকরা শাসন। করে। ছাদশ শতকে হিন্দু সেন বংশের উত্থান ও পরে মুসলিম। শাসনের ফলে ময়নামতির গুরুত্ব কমতে থাকে।

শাসকদের ভয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা এ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে থাকে। কারণ বৌদ্ধ শাসনামলে ময়নামতি ছিল পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ শাস্ত্র সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র। ফলে তখনকার সময়ে এখানে বৌদ্ধদের আনাগোনা বেশি ছিল।

৪. ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ : ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাসমূহের মধ্যে প্রধান প্রধান নিদর্শন হলো শালবন বিহার, আনন্দ বিহার কুটিলামুড়া, চারপত্র মুড়া, ভোজ বিহার, ময়নামতি প্রাসাদটিলা ইত্যাদি। 

নিম্নে সংক্ষেপে এগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলো :

(ক) আনন্দ বিহার : রোহিতগিরির নিদর্শনসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ নিদর্শন হলো আনন্দবিহার। এটি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভারে সমৃদ্ধ কোটবাড়ির কেন্দ্রে অবস্থিত। চারিদিকে বিহার, স্তূপ ও উপাসনালয় নিয়ে গঠিত ধর্ম ও শিক্ষার একটি বিরাট স্থাপনা ছিল এটি।

(খ) শালবন বিহার : ময়নামতির খননকৃত প্রত্নস্থান সমূহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শালবন বিহার। এটি খননের ফলে পাহাড়পুরের ন্যায় সুবৃহৎ বৌদ্ধ মঠ এবং সাত থেকে বারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ের মূল্যবান প্রব্যাদি পাওয়া গেছে আবিষ্কৃত দ্রব্যাদির মধ্যে রয়েছে আটটি তাম্রশাসন, চারশতেরও অধিক স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক, পাথর ব্রোঞ্চ ও মাঠির ভাস্কর্য।

(গ) ভোজ বিহার : ময়নামতিতে শালবন বিহার ও আনন্দ বিহারের পর তৃতীয় বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ মঠ স্থাপনাটি হলো ভোজবিহার। মঠটির পূর্ব দিকে একটির জলাধার রয়েছে শালবন বিহার ও আনন্দ বিহারের ন্যায় এটিও উন্মুক্ত আন্তিনার মাঝখানে ক্রুশাকৃতির একটি সুবৃহৎ উপাসনালয় সমৃদ্ধ ।

(ঘ) প্রাসাদ টিলা : ময়নামতি প্রাসাদ টিলা শৈলবাড়ির উত্তর প্রান্তের সর্ববৃহৎ ও সর্বোচ্চ ভিবি, কিংবন্তি অনুযায়ী এটি চন্দ্র বংশের সর্বশেষ জ্ঞাত রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের মা রানি ময়নামতির নামের সাথে জড়িত।

প্রত্নস্থলটির কেন্দ্রস্থলে সীমিত আকারে খননের ফলে এর বিভিন্ন অংশের সম্ভবত একটি দুর্গের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কিছু অংশ এবং একটি সুদৃঢ় কাঠামোর কোণসম্বলিত একটি প্রাসাদের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে। এটিই সম্ভবত ময়নামতিতে ধর্মবহির্ভূত একমাত্র নির্মাণ কাঠামো।

(ঙ) অন্যান্য নিদর্শনসমূহ : ময়নামতির অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে রূপবান মুড়া, ইটাখোলমুক্তা, চন্দ্রীমুড়া। এ সকল স্থানে পাওয়া গেছে মূর্তি, বিভিন্ন ধাতুর মুদ্রা, ভদ্রেশাসন, ভাঙ্গা মৃৎপাত্র প্রস্তর ফলক। 

অখননকৃত অন্যান্য প্রত্নস্থলের মধ্যে রয়েছে, ময়নামতি টিলা-২, আব্বাস আলী মুড়া, হাতি গড় টিলা, উজিরপুর চিলা, ঘিলা মুক্তা, বলগাজীর মুড়া ইত্যাদি ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রোহিতগিরি যেটা ময়নামতি নামে বেশি পরিচিত। এখানে খননকার্যের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার প্রাচীন জীবন ও সংস্কৃতির সকল দিক স্পষ্ট হয়েছে। 

এ অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিশদ তথ্য সরবরাহ করেছে। এতে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিভিন্ন তথ্য জানার পথ সুগম হয়েছে। 

আরও তাৎপর্যপূর্ণ এই যে, পোড়ামাটির নিদর্শনাদি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে এবং মৃৎপাত্র ও সাধারণ ব্যবহার্য দ্রব্যাদির তারিখ ক্রম নিরূপণ করে ময়নামতি এখন এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান ও গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করছে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ