রামপালের রাজ্যাভিযান সমূহ আলোচনা কর
রামপালের রাজ্যাভিযান সমূহ আলোচনা কর |
রামপালের রাজ্যাভিযান সমূহ আলোচনা কর
- অথবা, শাসক হিসেবে রামপালের কৃতিত্ব আলোচনা কর ।
- অথবা, শাসক হিসেবে রামপালের কৃতিত্ব/অবদান মূল্যায়ন কর।
উত্তর : ভূমিকা : ক্ষয়িষ্ণু পাল সাম্রাজ্যে শেষবারের মতো উজ্জীবিত হয়েছিল রামপালের রাজত্বকালে। বলা হয়ে থাকে বিলুপ্তির পূর্বে শেষ বিচ্ছুরণ ঘটেছিল তার রাজত্বকালে।
পাল শাসনের শেষ দিকে এসে রামপাল তার বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি সিংহাসনে আরোহণের পর যুক্ত রাজ্য পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন বিজয়াভিযান প্রেরণ করে সফল হন।
এছাড়াও তিনি কৈবত রাজাদের হাত থেকে পৈত্রিক সিংহাসন উদ্ধার করে এবং প্রতিবেশী রাজাদের পরাস্ত করে তার স্বীয় যোগ্যতা ও শক্তি প্রদর্শন করেন। এসব কারণে তাকে পাল আমলের শেষ যুগের সফল রাজা বলা হয়।
রামপালের পরিচয় ও সিংহাসনে আরোহণ : বরেন্দ্র অঞ্চল যখন কৈবর্তনের দখলে তখন পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন দ্বিতীয় মহীপালের ছোট ভাই দ্বিতীয় তরপাল।
তিনি দুই বছর পাল সাম্রাজ্য শাসন করেন। অতঃপর তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামপাল (১০৮২-১১২৪) পাল সাম্রাজ্যের কর্ণধার হন।
রামচরিতে শুরপালের সিংহাসন লাভ তার রাজত্বকালীন ঘটনাবলি ও তার মৃত্যু সম্পর্কে উপযুক্ত তথ্যাবলির অভাবে অনুমিত হয় যে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তরপালকে হত্যা করে রামপাল সিংহাসন দখল করেন।
রামপালের সিংহাসনে আরোহণ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও বুঝা যায় যে, রামপালই ছিলেন পালবংশের শক্তিশালী র
রামপালের রাজ্য অভিযান : পালবংশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ আলোকচ্ছটা ও শৌর্যবীর্য ছিল রামপাল। রামপাল উত্তর বাংলায় পাল আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পালদের রাজ্য বিস্তারের সক্ষমতা প্রমাণ করেন।
রামপাল নতুন রাজধানী রামাবতী থেকে রাজ্য শাসন করেন। রামপাল কামরূপ ও রাঢ় অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন এবং পূর্ব বাংলার বর্মন রাজাকে তার আধিপত্য স্বীকার করতে বাধ্য করেন।
পরে উড়িষ্যা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য তিনি গঙ্গ রাজার সাথে যুদ্ধ করেন। এসব ছাড়াও রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রামপালের যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে।
১. বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার : পালবংশের অত্যন্ত সুযোগ্য এবং বুদ্ধিদীপ্ত রাজা ছিলেন রামপাল। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন পালবংশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ আলোকচ্ছটা ছিলেন রামপাল।
সিংহাসনে বসেই রামাপাল বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের জন্য মনোনিবেশ করেন। তখন বরেন্দ্র শাসন করছিলেন দিব্য। তার মৃত্যুর তার ভাই এবং পরবর্তীতে তার পুত্র ভীম বরেন্দ্র শাসন করেন।
রাজা ভীমের সময়ে রাজা রামপাল বরেন্দ্র দখলের জন্য সামন্ত রাজাদের সহযোগিতা কামনা করলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে।
কিন্তু চতুর রাজা রামপাল তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে তার দলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন এবং শেষে পর্যন্ত বরেন্দ্রর রাজা ভীমকে হত্যা করার মাধ্যমে রামপাল বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার করেন।
২. হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার : রাজা রামপাল তার বীরত্বের পরিচয় দিয়ে যখন একের পর এক রাজ্য পুনরুদ্ধার শুরু করেন তখন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার নবীন শাসকবৃন্দ ভয়ে রামপালের সাথে সুসম্পর্কে জন্য চেষ্টা করে।
পূর্বদেশীয় বর্মনারাজ যখন দেখলেন রাজা রামপালের সাথে ঝামেলা করলে ক্ষতির সম্ভাবনা খুব বেশি তাই তিনি নিজেকে রক্ষা করার জন্য রামপালের সাথে কোন প্রকার দ্বন্দ্বে জড়াননি।
৩. কামরূপ দখল : রাজা রামপাল ক্ষমতায় বসার আে থেকেই কামরূপ অঞ্চলের কিছু অংশ পালনের ছিল। রাজা রামপাল ক্ষমতায় আসার পর যখন একের পর এক রাজ্য পুনরুদ্ধার শুরু করেন তখন তার একজন সামন্ত কামরূপ রাজার দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে কামরূপ দখল করে নেন। আর রাজা রামপালের সময়েই পূর্ণ কামরূপ পালবংশের অধীনে চলে আসে।
৪. কর্ণাটের আক্রমণ রোধ : রাজা রামপাল ক্ষমতায় আসার পর পালবংশের পূর্বের সব রাজ্য একের পর এক নী পুনরুদ্ধার শুরু করেন।
কর্ণাটের রাজা বিক্রমাদিত্য তখন বাংলা দখল করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, বিক্রমাদিত্য ছাড়াও কর্ণাটের সেনানায়ক ও মিথিলার নানাদের রামপালের বাংলার উপর আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু রামপাল খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
৫. উড়িষ্যা বিজয় : রামপাল এবার তার দৃষ্টি পূর্বদিক থেকে দক্ষিণ দিকে ফিরিয়ে মনোযোগ নিবন্ধ করেন। রাঢ় দেশের সামস্তরা রামপালের দৃশ্যতা স্বীকার করার ফলে রামপাল এদিক দিয়ে উৎকল আক্রমণ করে।
কলিঙ্গ রাজ অনন্ত বর্মা চোড়গঙ্গাকে রামপাল পরান্ত করতে পারেনি। অনন্ত বর্মার লিপিমালা থেকে জানা যায় যে, ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পূর্বেই উড়িষ্যায় রামপাল তার রাজ্য বিস্তার করেছিল।
৬. যুক্ত প্রদেশ রাজ্য প্রতিষ্ঠা : রাজা রামপাল ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক রাজ্য দখল করে নিজের সক্ষমতার পরিচয় দেন। তিনি ক্ষমতায় আসার অল্প সময়ের মধ্যে মগধসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য দখল করেন।
কিন্তু কনৌজের পবিন্দ চন্দ্র গহড়বাল রামপালের মগধ দখলের চেষ্টা করে। গবিন্দ চন্দ্রের এ ব্যবহারে রাজা রামপাল কৃষ্ণ হয়ে তার উপর আক্রমণ করে যুক্তপ্রদেশ পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।
৭. রামপালের কৃতিত্ব : রামপাল পৈতৃিক সিংহাসন উদ্ধার করে এবং প্রতিবেশী রাজাদের পরাস্ত করে দ্বীয় যোগ্যতা ও শক্তি প্রদশন করেন। পালবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা হিসেবে রামপালকেই গণ্য করা হয়।
পালবংশের অনিবার্য পতনকে রোধ করে তিনি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে সত্যিই বিরল। তিনি ভারতের আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে সংঘবন্ধ করেন।
তাছাড়া ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত শক্তির প্রভাবকে রোধ করতে তিনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কেননা একক কোনো রাজা একক রাজ শক্তিনা খ বিচ্ছিÆতাকে রোধ করতে পারে না এ কথা তিনি যথযথভাবে অনুধাবন করে অপরিসীম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।
তার উদ্যম, শ্রম, জ্ঞান, প্রতিভা ও অধ্যবসায় দেখে দেবী রামলক্ষ্মী যেন তার উপর তুষ্ট হলেন। তিনি বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার করেন, বাংলার সর্বত্র রাজত্ব বিস্তার করেন।
এছাড়াও তিনি কামরূপ ও উৎকল জয় করেন। দক্ষিণে দ্বিগজয়ী বীর অনন্তবর্মা চোড় গঙ্গা এবং পশ্চিমে চালুক্য ও গহড়বাল এ তিনটি রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সর্বপোরি পাল সাম্রাজ্যে সুদৃঢ়করণে তিনি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই অতুলনীয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রামপালের রাজত্বকাল নিঃসন্দেহে পাল শাসনামলের একটি গৌরবময় অধ্যায়। তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন পাল সাম্রাজ্যে ছিল এক অস্বস্থিকর পরিবেশের মধ্যে।
রামপাল সিংহাসনে আরোহণ করে পাল সাম্রাজ্যের হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং পাল | সাম্রাজ্যের সীমানাকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন।
লামাতারনাথের মতে, তিনি প্রায় ৪৬ বছর রাজত্ব করেন। তার এ দীর্ঘ রাজত্বকাল পাল সাম্রাজ্যেকে আরও গৌরবে আসীন করে দেয়। তাই বলা যায় পালবংশের শেষ ও শ্রেষ্ঠ রাজা হলেন রামপাল ।