রাজা লক্ষ্মণ সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব বিস্তারিত আলোচনা কর
রাজা লক্ষ্মণ সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব বিস্তারিত আলোচনা কর |
রাজা লক্ষ্মণ সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব বিস্তারিত আলোচনা কর
- অথবা, রাজা লক্ষ্মণ সেন কেমন ছিলেন? তার সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দাও।
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে রাজা লক্ষ্মণ সেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সেন রাজ বংশ বাংলায় একশ বছর শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন, তাদের মধ্যে লক্ষ্মণ সেনকে সেন বংশের পতনের কারণ বলা হয়।
কিন্তু বাংলায় তার শাসনামলে মুসলিমদের জয়ী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি একজন সফল শাসক ছিলেন। তিনি দক্ষতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তার শাসনামলে রাজ্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার সময়ে তিনি যোদ্ধা হিসেবে তেমন সফলতা দেখাতে না পারলেও তার পিতা বল্লাল সেনের আমলে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় ছিলেন।
যদিও পিতার সাথে 'তার কোনো একটি পারিবারিক বিষয় নিয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তার অবসান হয়।
→ লক্ষ্মণ সেনের পরিচয় : লক্ষ্মণ সেন সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের পুত্র ছিলেন। তবে তার বাল্যকাল সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না।
যেটুকু জানা যায় তা হলো তিনি রাজপুত্র হওয়ার কারণে অনেকটা বিলাসী জীবনযাপন করেছেন, তখনকার | সময়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা তিনি অর্জন করেন।
যৌবনে পিতা ও পিতামহের সাথে যুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, তিনি কলিঙ্গ দেশে অভিযান পরিচালনা করেন।
পিতা ও পিতামহের রাজত্বকালে গৌড় অভিযানে অংশ নেন এবং কলিঙ্গ ও কামরুপ জয় করেন বলে ধারণা পাওয়া যায় ।
→ সিংহাসনে আরোহণ ও রাজশাসন : তাবাকাতে নাসিরি গ্রন্থের লেখক মিনহাজ উদ্দিন লিখেছেন, লক্ষ্মণ সেন (১১৭৮- ১১৭৯) খ্রিষ্টাব্দে ৬০ বছর বয়সে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেন।
তিনি তার পিতার রাজ্যসীমা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন এবং পুরী, কাশী ও এলাহাবাদে বিজয় লাভ করেন। তিনি কনৌজের গাজেরাল বংশীয় রাজাকে পরাজিত করেন এবং বাংলার বাইরেও একাদিক সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন।
লক্ষ্মণ সেনের চরিত্র ও কৃতিত্ব : সেন বংশের অন্যতর শাসক লক্ষ্মণ সেনের ব্যক্তিগত জীবন, চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা করার পূর্বে তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলো ।
লক্ষণ সেনের চরিত্র : লক্ষ্মণ একাধারে সমরকুশলী সেনানায়ক, পরমবৈষ্ণব ধর্মানুরাগী, লেখক, বিদ্যোৎসাহী ও জন কল্যাণকর শাসক ছিলেন।
নিম্নে তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো :
১. বৈষ্ণম ধর্মানুরাগী : লক্ষ্মণ সেন ছিলেন বৈষ্ণব মতবাদের কঠোর অনুসারী। এজন্য তিনি 'পরমবৈষম' বা পরম নরসিংহ উপাধি ধারণ করেন।
তার পিতা বা পিতামহের তাম্রশাসনে যেখানে শিবের স্তুতিবাচক শ্লোক এবং মুদ্রায় সদাশিবের মূর্তি অঙ্কিত থাকতো সেখানে তার তাম্রশাসনে দেখা যায় নারায়ণের স্তুতিবাচক শ্লোক। তিনি আমৃত্যু ধর্মানুরাগী ছিলেন।
২. বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী : লক্ষ্মণ পিতা বল্লাল সেনের মতো বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। তিনি তার পিতা কর্তৃক রচিত 'অদ্ভুত সাগর' নামক গ্রন্থটির বাকি অংশ লিখে সমাপ্ত করেন।
তিনি সে সময়ে কবিতার শ্লোকও লিখেছিলেন যা পরবর্তীতে পণ্ডিতদের হস্তগত হয়েছে, শ্রীধর দাস কর্তৃক সংকলিত সদোত্তি কর্ণাসহ নামক সংস্কৃত গ্রন্থে লক্ষ্মণ সেন ও তার পিতার কয়েকটি কবিতা সংকলিত হয়েছে।
তিনি জ্ঞানী, পণ্ডিত ব্যক্তি, কবিতা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার রাজ্যসভা জ্ঞানী- পণ্ডিত ব্যক্তিদের পদভারে মুখরিত ছিল।
এ সকল কবিদের মধ্যে জয়দেব বিখ্যাত কবি ছিলেন। গীত গোবিন্দ তার রচিত অন্যতম একটি গ্রন্থ। তার রচিত জনপ্রিয় পদাবলির একটি হলো বৈষ্ণব পদাবলি।
গোবর্ধন ছিলেন একজন বিখ্যাত গ্রন্থকার। তিনি আর্য- সপ্তসতী নামক একটি গ্রন্থ রচনা করে লক্ষ্মণ সেনের রাজদরবার অলংকৃত করেন।
লক্ষ্মণ সেনের রাজদরবারের বিখ্যাত কবিদের মধ্যে কবি ধোয়ী, শরণ, উমাপতি ধর ও হলায়ুধের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লক্ষ্মণ সেনের আমলকে এজন্য সংস্কৃতি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয় ।
৩. উদারচেতা ও পরাক্রমশালী : রাজা লক্ষণ সেন তার অসামান্য গুণাবলি ও দানশীলতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন তবাকাতই নাসিরি গ্রন্থের লেখক মিনহাজ-উস-সিরাজ তার দানশীলতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে বাংলার 'মহান রায়' হিসেবে অভিহিত করেন এবং দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের সাথে তুলনা করেন।
তিনি লক্ষ্মণ সেনকে হিন্দুস্থানের রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খলিফার মতো বলে বর্ণনা করেছেন এবং তার শাসননীতি সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেছেন।
তিনি আরো বলেছেন যে, সারা হিন্দুস্থানে তার মতো আর কেউ সম্মানিত রাজা ছিলেন না। তিনি কারো প্রতি অত্যাচারের হস্ত প্রসারিত করেননি। তিনি যখন দান করতেন তখন তা অবশ্যই এক লক্ষ কড়ির কম হতো না।
তার শাসনকালের শেষ দিকে অবশ্য লক্ষ্মণ সেন রাজকার্য পরিচালনায় অশক্ত হয়ে পড়েন। এই সময় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ও সংহতির অভাব পরিলক্ষিত হয়।
লক্ষ্মণ সেনের কৃতিত্ব : লক্ষণ সেনের যে সমস্ত কৃতিত্বের কথা জানা যায় তার মধ্যে তার সামরিক কৃতিত্বই বেশি।
নিম্নে তার কৃতিত্বসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. কলিঙ্গ বিজয় : মাধাইনগর লিপি ও ভাওয়াল লিপিতে উল্লেখ রয়েছে যে, লক্ষ্মণ সেন যৌবনে কলিঙ্গ দেশে অভিযান পরিচালনা করেন।
লক্ষ্মণ সেনের পূর্বসুরি রাজা বিজয় সেনের আমলে কামরুপ রাজকে পরাজিত করেছিলেন লক্ষ্মণ সেন নিজে অর্থাৎ লক্ষণ সেন পিতামহ বিজয়সেনের সঙ্গে কলিঙ্গ অভিযানে অংশগ্রহণ করে সফল হন। পরবর্তীতে কলিগ দেশ সেন শাসনাধীনে কতদিন স্থায়িত্ব লাভ করেছিল সে সম্পর্কে জানা যায় না।
২. গৌড়েশ্বরের শ্রীহরণ : লক্ষ্মণ সেনের মাধাইনগর পিপি ও ভাওয়াল লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি গৌড়েশ্বরের শ্রীহরণ করে পৌড় বিজয় করেছিলেন।
তার গৌড় বিজয়কালে তৎকালীন গৌড়ের রাজা দ্রুত পলায়নে বাধ্য হন। আর তার গৌড় বিজয় সংঘটিত হয়েছিল পিতামহ বিজয়সেনের আমলে।
এ কারণে তার নামানুসারে গৌড়ের রাজধানীর নাম লক্ষ্মণাবতী রাখা হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন লক্ষ্মণ সেন গৌড় পুনর্বার বিজয় সম্পন্ন করেছিলেন।
৩. চেলিরাজের পরাজয় : লক্ষণ সেনের সভাকবি উমাপতি ধর ও শরণ রচিত "শ্লোকে লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক চেদিরাজকে পরাজিত করার তথ্য পাওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশের একটি লিপিতে গৌড় রাজের সঙ্গে চেনিবংশের সংঘর্ষের তথ্য রয়েছে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রতনপুরের কলচুরি (চেদি) রাজগণের সামন্ত রাজবল্লভরাজ গৌড়রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, চেদি বংশের সঙ্গে গৌড় রাজাদের একটি সংঘ সংঘাত হয়েছিল।
৪. প্রাগজ্যোতিষের আনুগত্য লাভ : প্রাগজ্যোতিষ বা কামরুপ রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলে না বিজয় সেনের শাসনামলে সেন শাসনাধনে আসে তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।
উল্লেখ পাওয়া যায়, প্রাগজ্যোতিষ বা কামরুপের রাজা ভীত হয়ে লক্ষ্মণ সেনের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন। আবার এটিও জানা যায় যে, লক্ষ্মণ সেনের পিতামহ বিজয়সেন কামরুপ রাজকে দূরীভূত করেন।
এক্ষেত্রে লক্ষণ সেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ধারণা করা যায় যে, বিজয় সেন কামরুপ রাজাকে বিতাড়িত করলেও তা বিজয় সফলতা সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি। পরবর্তীতে রাজা লক্ষ্মণ সেন কামরুপ বিজয় সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করেন।
৫. কাশিরাজের পরাজয় : লক্ষ্মণ সেন কাশিরাজকে পরাজিত করেছিলেন। বিজয়সেন ইতোপূর্বে নৌ অভিযানের মাধ্যমে পাশ্চাত্যচক্র বা গাহড়বাল অভিযান করেছিলেন।
সেন শাসনামলে গাহড়বাল রাজাদের সঙ্গে সেনদের সম্পর্ক সুপ্রকর ছিল না। কাশি অঞ্চলের রাজা জয়চন্দ্রকে লক্ষণ সেন পরাজিত করেন।
এ সময় গাহড়বাল রাজার সঙ্গে লক্ষ্মণ সেনের যুদ্ধ হয়েছিল। এ তথ্য জৈনহগ্রস্থ প্রবন্ধকোষ বা পুরাতন প্ৰবন্ধ সমাহ গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়।
৬. ম্লেচ্ছরাজের পরাজয় : লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি উমাপতি ধর ও শরন রচিত শ্লোকে লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক ম্লেচ্ছরাজের পরাজয়ের তথ্যও পাওয়া যায়।
নীহার রঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন যে, বখতিয়ার খলজির নদীয়া জয়ের পূর্বে বা পরে লক্ষ্মণ সেন তার বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করেছিলেন।
তবে ম্লেচ্ছদের পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন গ্রেছ বলতে আরাকানী মগদের বুঝানো হয়েছে।
তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে মনে করা হয় যে, আরাকানী মগরা লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালে বাংলার এসেছিলেন এবং তার হাতে পরাজিতও হয়েছিলেন।
→ লক্ষ্মণ সেনের পতন : ১২০৪ সালে তুর্কি সামরিক নেতা বিন বখতিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণ করে এর কিছু দিন পূর্বে লক্ষ্মণ সেন নদীয়ায় অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
বখতিয়ার খলজি নদীয়া আক্রমণ করলে বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে যান। তবে তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে শাসনকার্য চালিয়ে যান তার মৃত্যুর পর তার পুত্র বিশ্বরূপ সেন রাজা হন।
লক্ষ্মণ সেন ১২২৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার পর থেকে সেন শাসন দুর্বল হতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত বিদ্রোহের ফলে সেন রাজ্যের পতন ঘটে।
উপসংহার : আলোচনার পরিসমাপ্তিতে বলা যায় যে, সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন তার কাজে, দক্ষতায়, বিদ্যা ও ধর্মপালনে অনন্য একজন শাসক ছিলেন।
তিনি যুবক বয়সে তার পিতামহ ও পিতার শাসনামলে অসংখ্য যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন এবং ক্ষমতায় আরোহণ করে বৃদ্ধ বয়সেও দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশের শত্রুদের তিনি দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেন।
যদিও শাসন ক্ষমতা লাভের পরে স্বশরীরে যুদ্ধ করতে পারেননি বয়সের আধিক্যের কারণে। তিনি তার শাসনামলে শিক্ষাসংস্কৃতি ক্ষেত্রে, জনকল্যাণে ব্যাপক অবদান রাখেন।
তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি নানা কুসংস্কার ও জ্যোতিষীর কথায় বিশ্বাস করতেন। অনেকেই তাকে সেন বংশের পতনের কারণ বলে দায়ী করেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ এবং যুগের বাস্তবতায় এবং ভাগ্যের ঘোরে তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে ।