প্রাচীন পাল ও সেন বংশের শাসনব্যবস্থার তুলনা কর
প্রাচীন পাল ও সেন বংশের শাসনব্যবস্থার তুলনা কর |
প্রাচীন পাল ও সেন বংশের শাসনব্যবস্থার তুলনা কর
- অথবা, পাল ও সেন যুগের শাসনব্যবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র অঙ্কন কর।
- পাল ও সেন যুগের শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা কর।
- অথবা, পাল যুগের ও সেন যুগের শাসনব্যবস্থার সাদৃশ ও বৈসাদৃশ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : পাল ও সেন যুগে বাংলার প্রশাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা খুবই কষ্টসাধ্য। বিভিন্ন উৎসের সাহায্যে রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের উপকরণ খুবই সীমিত।
আবিষ্কৃত লিপিমালার প্রাপ্ত অপর্যাপ্ত তথ্যই পাল ও সেন আমলের শাসনব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নের একমাত্র উৎস বলে বিবেচিত।
বিশেষ করে তাম্র শাসনসমূহে লিপিবদ্ধ রাজকর্মচারীদের উপাধি থেকে সে আমলের প্রশাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব।
পাল ও সেন যুগের তুলনামূলক শাসনব্যবস্থা : পাল আমলের শাসনব্যবস্থার আদলে সেন শাসন প্রণালি গঠন করা হয়েছিল। তবে কিছু সংস্কারও করা হয়েছিল। নিম্নে পালবংশের চারশত বছর এবং সেন বংশের দুইশত বছরের শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করা হলো :
১. রাজ্য সীমান্ত : শুধু বাংলায় নয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে পালবংশ এক বিশেষ মহান দখল করে আছে। পালবংশের সীমানা পূর্বদিকে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিম দিক দিল্লি ও জয়পুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
অন্যদিকে সেন বংশের আমলে বিজয় চার সমুদ্র বেষ্ঠিত সকল ভূখণ্ড জয় করে ছিলেন। সেন রাজার পশ্চিম ও উত্তর বাংলা থেকে বর্ম শাসনের অবসান ঘটিয়ে সমগ্র বহু দেশে আধিপত্য বিস্তার করেন।
২. শাসনব্যবস্থা : পাল আমলেই প্রাচীন বাংলায় সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় শাসন গড়ে উঠে। গুপ্ত শাসনামলের মতই পাল আমলে ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল প্রভৃতি প্রশাসনিক বিভাগের বর্ণনা পাওয়া যায় ।
মেদেনীপুর জেলায় অবস্থিত বর্তমান ও পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি উভয় বিহারে নিহত এবং আসাম প্রাগ জ্যোতিষ ভুক্তির নমুনা স্বাক্ষর করা করা হয়। তবে ভুক্তির অন্তর্গত আরো উপপ্রশাসনিক বিভাগ ছিল ।
পুষ্পভুক্তির সীমানা সেন আমলে অনেক বিস্তৃত হয়েছিল। অন্যদিকে বর্তমান ভুক্তির সীমানা সংকুচিত হয়েছিল।
তার উভয় পদ্ধতিতে সর্বময় ক্ষমতা রাজা অধীনে ছিল। পাল আমলে ভুক্ত মণ্ডল বিভাগ ছাড়াও আরো তিন প্রশাসনিক বিভাগ ছিল।
৩. রাজকীয় উপাধি : একজন পাল রাজাই ছিলেন পাল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। সেন আমলে একটু পদ্ধতি ছিল। উভয় আমলে রাজার ক্ষমতা ছিল সর্বময়।
গুপ্তদের মত সেন রাজারা ও পরমেশ্বর পরম ভট্টারক, মহারাজা ধিরাজ, মহারাজধিরাজ উপাদি গ্রহণ করতেন। কিন্তু সেন বংশের লক্ষণ সেও অশ্বপতি গজপতি নরপতি উপাধি গ্রহণ করতেন ।
৪. সামন্ত শাসন : পালযুগে সামন্ত শাসনব্যবস্থার প্রচলন ছিল। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলে সামন্ত রাজারা পাল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে নির্দিষ্ট অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত করতো। সেন যুগে সামন্ত শাসনব্যবস্থার প্রভাব কমতে থাকে।
৫. রাজস্ব ব্যবস্থা : পাল শাসনামলে প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা কর্মচারী নিয়োগ করে সুষ্ঠুভাবে কর আদায় করা হতো। ভাগ, ভোগ, হিরণ্য নামে বিভিন্ন ধরনের কর ঘাত করে কর আদায় করা হতো।
পাল আমলে ভূমির মাপকাঠি উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণে। কিন্তু সেন আমলে দেখা যায় ভূমি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ভূমিকে রাজস্ব আদায়ের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেন আমলে হস্তের মাপই ছিল ভূমি পরিমাপের একক। বিভিন্ন এলাকায় ৫৬ হাত পরিমাপের নল ব্যবস্থার হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে পাল ও সেন আমলে একই রকম রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
সেখানে রাজ্যের সকল প্রকার শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শাসন বিভাগ ছিল এবং প্রত্যেক বিভাগে প্রত্যেক বিভাগে একজন অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। তার অধীনে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হতো।
৬. রাজকীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী : কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের তথ্যানুযায়ী শাসনব্যবস্থার যে রূপ ও পদ্ধতি ছিল, পাল ও সেন আমলেও সে ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা লক্ষিত হয়।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দেখা যায় যে, রাজ্যের সকল প্রকার শাসনকার্য নির্বাহের লক্ষ্যে কিছু নির্দিষ্ট শাসন বিভাগ ছিল।
এসব শাসন বিভাগে প্রত্যেকটিতে একজন অধ্যক্ষ নিযুক্ত থাকতেন। পাল ও সেন আমলে মহাসন্ধি বিগ্রহিক রাজ্যগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গুপ্ত যুগের শাসন কাঠামোর উপর ভিত্তি করে পাল যুগে একটি সুনিয়ন্ত্রিত শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পাল শাসনের সুবিন্যাস্ত শাসনব্যবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত আকারে চন্দ্র ও সেন যুগে পরিচালিত হয়েছিল এবং কিছু নতুন পদ ও পদবির উদ্ভব ঘটেছে।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী শাসন কার্যক্রম বজায় রেখে পাল ও সেন বংশ বাংলার বুকে অন্যতম স্থান অর্জন করার কৃতিত্ব লাভ করেছে। সর্বোপরি প্রাচীন বাংলার গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা তাদের সময় থেকেই শুরু হয়ে ছিল