প্রাচীন ইতিহাসে শশাঙ্কের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর। তিনি কি শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন
প্রাচীন ইতিহাসে শশাঙ্কের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর। তিনি কি শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন |
প্রাচীন ইতিহাসে শশাঙ্কের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর। তিনি কি শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন
- অথবা, শশাঙ্কের শ্রেষ্ঠত্বের বিশেষ উল্লেখ পূর্বক বাংলার প্রথম নৃপতি হিসেবে শশাঙ্কের রাজত্বকাল আলোচনা কর।
- অথবা, প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের শাসনকাল পর্যালোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বাঙালি রাজাগণের মধ্যে শশাঙ্কই ছিলেন প্রথম সার্বভৌম নরপতি। তিনি সামস্তরূপে জীবন আরম্ভ করে নিজ দক্ষতা ও যোগ্যতা বলে স্বাধীন গৌড় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি পুণ্ড্রবর্ধন ও গৌড় বঙ্গকে একত্রিত করে স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ড. নীহাররঞ্জন শশাঙ্ককে কীর্তিমান নৃপতি বলে উল্লেখ করেছেন।
শশাঙ্কের রাজত্বকাল : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের রাজত্বকাল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে শশাঙ্ক বাংলাসহ বাংলার আশেপাশে তার সম্রাজ্যের বিস্তৃত করতে সক্ষম হন।
নিচে তার রাজত্বকাল সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. রাজধানী হিসেবে কর্ণসুবর্ণের প্রতিষ্ঠা : শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহণের পর তার রাজধানী হিসেবে কর্ণসুবর্ণকে বেঁছে নেন। তিনি কর্ণসুবর্ণকে সম্পদে পরিপূর্ণ একটি নগরে পরিণত করতে সক্ষম হন। এছাড়াও অন্যান্য রাজ্যের জন্য শশাঙ্কের রাজত্বকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
২. মানবংশের সাথে সংঘর্ষ : গৌড়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর শশাঙ্ক সর্বপ্রথম মানবংশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন।
এ সংঘর্ষে মানবংশ পরাজিত হন। মানবংশকে পরাজিত করার মাধ্যমে শশাঙ্ক স্বীয় রাজ্য সীমানা দক্ষিণে গগ্রাম জেলার মহেন্দ্রগিরি পর্যন্ত অধিকার করতে সক্ষম হন।
৩. শশাঙ্কের মগধ ও বারানসি অধিকার : শশাঙ্ক তার রাজ্যসীমা দক্ষিণে বিস্তৃতির পর পশ্চিম সীমান্তে বিস্তৃতির জন্য অগ্রসর হন।
তিনি মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে সন্ধি স্বাক্ষর করার পর পশ্চিমে মগধ অঞ্চল অধিকার করেন। এরপর তিনি আরো অগ্রসর হয়ে গঙ্গরা খাত ধরে বারানসি পর্যন্ত গঙ্গার উপকূল অধিকার করেন।
৪. উত্তর ভারতের রাজনীতিতে শশাঙ্কের হস্তক্ষেপ : শশাঙ্ক উক্ত অঞ্চলসমূহ জয় করার পর তার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন।
রাজ্যে শাস্তি প্রতিষ্ঠা করার পর শশাঙ্ক উত্তর ভারতে রাজ্য বিস্তারের মনোবাসনা করতে থাকেন যার ফলে তিনি উত্তর ভারতের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
এছাড়া কনৌজের মৌখরিরাজদের পতন ঘটানোও ছিল শশাঙ্কের উত্তর ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অন্যতম কারণ।
৫. শশাঙ্কের মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন : কনৌজের মৌখরিরাজ গ্রহবর্মণ থানেশ্বর পুষ্যভূতি রাজার কন্যাকে বিবাহ করার মাধ্যমে তাদের দ্বৈতশক্তি সৃষ্টি হয়। ফলে শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীনতার প্রশ্নে শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
তিনি গৌড়ের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে ও থানেশ্বরের রাজার আক্রমণ প্রতিহত করতে মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন।
উল্লেখ্য যে, মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে কনৌজ রাজদের দ্বন্দ্বের কারণে শশাঙ্ক এ সন্ধি স্থাপন করতে সক্ষম হন।
৫. দেবগুপ্তের কর্তৃক মৌখরিরাজকে আক্রমণ : উক্ত জোট গঠন করার আগে মৌখরি- থানেশ্বর জোট গঠন করেছিলেন উক্ত দুবংশের শাসকেরা।
মালবরাজ দেবগুপ্ত থানেশ্বর রাজা প্রভাকরবর্ধনের অসুস্থতার সুযোগে কনৌজ রাজকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কনৌজের রাজা গ্রহবর্মণ পরাজিত ও নিহত হন। ফলে কনৌজ দেবগুপ্তের হস্তগত হয়।
৭. রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু : কনৌজের রাজার মৃত্যুর ও পরাজয়ের কথা শুনে থানেশ্বর রাজা কনৌজের দিকে অগ্রসর হন। মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে বুদ্ধে মালবরাজকে পরাজিত ও নিহত করেন এবং রাজ্যশ্রীকে কারাগারে থেকে মুক্ত করেন। পথিমধ্যে গৌড় রাজা শশাঙ্কের সাথে রাজ্যবর্ধনের যুদ্ধ হয় যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন পরাজিত ও নিহত হন।
৮. হর্ষবর্ধনের সাথে শশাঙ্কের সংঘর্ষ : গৌড় রাজা শশাঙ্কের কাছে যুদ্ধে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তার ভাই হর্ষবর্ধন ভ্রাতৃপ্রতিশোধ নিতে শশাঙ্কের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুতি নেন।
তিনি সেনাপতি ভক্তির অধীনে সৈন্যবাহিনী রেখে রাজ্যশ্রীকে বিন্ধ্য পর্বত থেকে উদ্ধার করেন পরে গঙ্গা নদীর তীরে তারা একত্রিত হলে হর্ষবর্ধন আবার সেনাবাহিনীর সাথে একত্রিত হন।
তবে এরপর কি ঘটে তার সম্পর্কে জানা যায়নি। কারণ বানভট্ট এ সম্পর্কে আর লেখেননি। তবে বিভিন্ন তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, শশাঙ্ক ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গৌড় শাসন করেন সুতরাং বোঝা যায় যুদ্ধ হলেও হর্ষবর্ধন তেমন লাভবান হতে পারেননি।
শশাঙ্কের শ্রেষ্ঠত্ব : শশাঙ্ক ছিলেন একজন অজ্ঞাত বংশ পরিচয়হীন ব্যক্তি। তিনি তার নিজ দক্ষতার মাধ্যমে গৌড়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটান এবং তিনিই প্রথম বাংলার প্রথম রাজা হওয়ার [ অধিকার হওয়ার অর্থাৎ জাতীয় রাজা হওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হন।
নিচে তার শ্রেষ্ঠত্ব আলোচনা করা হলো :
১. সার্বভৌম বাংলার প্রতিষ্ঠা : শশাঙ্কই সর্বপ্রথম বাংলায় সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ছাড়া আর কেউ এ গৌরব অর্জন করতে পারেনি।
২. দক্ষশাসক : শশাঙ্ক ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। তিনি রাজ্য জয়ের পাশাপাশি রাজ্যর শাসনব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শাসনব্যবস্থার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. প্রজাহিতৈষী শাসক : শশাঙ্ক ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী শাসক। তিনি প্রজাদের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন, রাজধানী কর্ণসুবর্ণকে তিনি সম্পদে পরিপূর্ণ করেন।
৪. সুচতুর কূটনীতিবিদ : শশাঙ্ক ছিলেন একজন সুচতুর কূটনীতিবিদ কারণ তিনি মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে দক্ষতার পরিচয় দেন। এছাড়া শশাঙ্ক উত্তর ভারতে রাজনীতিতে তাঁর মেধার পরিচয় দেন।
৫. রাজ্য বিজেতা : শশাঙ্ক ছিলেন একজন সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির জন্য বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে একথা বলা যায় যে, শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার ইতিহাসে একজন সফল রাজনীতিবিদ ও শাসক।
সামান্য এক সামন্তরূপে জীবন শুরু করার মধ্য দিয়ে আরম্ভ করলেও তিনি তার অধ্যায়নে স্বাধীন গৌড় রাজ্যের উত্থান ঘটাতে সক্ষম হন।
তাই শশাঙ্ককে বাংলার প্রথম সার্বভৌম জাতীয় রাজা বলা হয়। সাথে সাথে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি।