প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে শশাঙ্কের উত্থান আলোচনা কর

প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে শশাঙ্কের উত্থান আলোচনা কর
প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে শশাঙ্কের উত্থান আলোচনা কর


প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে শশাঙ্কের উত্থান আলোচনা কর

  • অথবা, শশাঙ্কের উত্থান সম্পর্কে বিবরণ দাও। 

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের উত্থান এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। যদিও শশাঙ্কের বাল্য জীবন সম্পর্কে জানার জন্য আমরা অনেক কম উৎস পাই তবে যে তথ্য পাই সেগুলো বিচার করলে আমরা দেখতে পাই যে, বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের উত্থান কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।

মৌখরি ও পরবর্তী গুপ্ত বংশ তারা পরস্পরের মধ্যে বংশানুক্রমিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এক পর্যায়ে গুপ্ত শাসকেরা হীনবল হয়ে পড়লে শশাঙ্ক গৌড় অধিকার করে স্বাধীন গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

[] প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে শশাঙ্কের উত্থান : নিচে প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে শশাঙ্কের উত্থানের ইতিহাসে বর্ণনা করা হলো :

১. গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন : ৫৫১ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্ত সম্রাজ্যের পতনের ফলে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর আবার নতুন স্বাধীন রাজবংশের উত্থান ঘটে। এগুলোর মাধ্যমে পৌড় রাজ্যের উত্থানও ঘটে।

২. পরবর্তী গুপ্তবংশের উত্থান ও অন্যান্য স্বাধীন রাজবংশ : গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর যে নতুন রাজবংশগুলোর উত্থান ঘটে সেগুলোর মধ্যে পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশ অন্যতম। এছাড়াও কনৌজে মৌখরি রাজবংশ থানেশ্বরের পুষ্যভৃতি রাজবংশ ছিল অন্যতম ।

৩. স্বাধীন গৌড় রাজ্যের উত্থান : গুপ্ত শাসনের পতনের পর পঠিত নতুন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পরবর্তী গুপ্তবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় গৌড় ও মগধ রাজ্যকে কেন্দ্র করে। 

এসময় পরবর্তী গুপ্ত বংশের একমাত্র শত্রু রাষ্ট্র ছিল মৌখরি রাজারা। মৌখরি রাজা ও পরবর্তী গুপ্ত বংশের রাজাদের মধ্যে শত্রুতা ছিল বংশনানুক্রমিক। 

পরবর্তী গুপ্তবংশের শাসকদের ভাই সবসময় কনৌজ রাজাদের সাথে সংঘর্ষে মেতে থাকতে হতো। তাছাড়া চালুক্যরাজ কীর্তিবর্মার সাথে গুপ্ত রাজাদের শত্রুতা ও তার আক্রমণ ও তিব্বতীয় রাজা শুংসান এর আক্রমণের ফলে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে পরবর্তী গুপ্ত বংশের শাসকেরা হীনবল হয়ে পড়ে। 

এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শশাঙ্ক ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে কোনো এক সময় বাংলায় স্বাধীন সার্বভৌম গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

৪. দক্ষিণে রাজ্য সম্প্রসারণ : শশাঙ্ক নিজেকে শুধু স্বাধীন গৌড়ের সার্বভৌম রাজা হিসেবে দেখতে পছন্দ করতেন না। তাই তিনি তার সাম্রাজ্য দক্ষিণে সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ নেন। 

তিনি মানবংশের পরাজিত করার মাধ্যমে দক্ষিণে গঞ্জাম জেলার মহেন্দ্রগিরির পবর্ত পর্যন্ত প্রসারিত হন। তাছাড়াও তিনি দণ্ডযুক্তি, উকূল, কঙ্গোস জয় করে দক্ষিণে স্বীয় রাজ্য সম্প্রসারণ করেন।|

৫. মগধ ও বারানসি জন্ম : দক্ষিণে রাজ্য বিস্তারের পর শশাঙ্ক পশ্চিমে রাজ্য জয়ের জন্য মনঃস্থির করেন। তিনি মালব রাজদেবগুপ্তের সাথে চুক্তি সম্পাদনের পর মগধ অধিকার করেন। 

তারপরে তিনি আরো অগ্রসর হয়ে গঙ্গার খাত হতে বারানসি পর্যন্ত গঙ্গার উপকূল অধিকার করেন। ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকায় শশাঙ্কের আধিপত্য স্থাপিত হয়।

৬. মৌখরি ও পুষ্যভূতি রাজবংশের সাথে সংঘর্ষ : শশাঙ্ক গৌড়ের শাসনব্যবস্থায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি মৌখরি ও পুষ্যভূতি রাজবংশের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন। 

তাছাড়া কনৌজের রাজা গ্রহবর্মণ তিনি থানেশ্বর রাজার কন্যাকে বিবাহ করার মাধ্যমে তার শক্তিকে বৃদ্ধি করে যা ছিল শশাঙ্কের সাথে সংঘর্ষের অন্যতম কারণ।

৭. মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন : শশাঙ্ক নিজ রাজ্যকে শত্রুমুক্ত করতে এবং শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য বিরোধি জোট গঠন করেন। শশাঙ্ক মালবরাজদের গুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। 

উল্লেখ্য যে, মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে কনৌজরাজ গ্রহবর্মণের পূর্ব থেকেই শত্রুতা ছিল। তাই শশাঙ্ক খুব সহজেই বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন।

৮. থানেশ্বররাজ রাজ্যবর্ধনের সাথে সংঘর্ষ : দেবগুপ্ত কনৌজ রাজ গ্রহবর্মণকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। ফলে থানেশ্বররাজ রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে আক্রমণ করেন। 

যুদ্ধে দেবগুপ্ত রাজ্যবর্ধনের কাছে পরাজিত ও নিহত হয়। রাজ্যবর্ধন | যখন কনৌজ জয় করে ফিরছিলেন তখন তাকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। 

গৌড়রাজ শশাঙ্কের সাথে রাজ্যবর্ধনকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এ যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের নিকট পরাজিত ও নিহত হন। 

ফলে কনৌজ শশাঙ্কের শাসনাধীনে চলে আসে। রাজ্যবর্ধন যখন কনৌজ অভিযানে আসেন তখন তার ছোট ভাই হর্ষবর্ধনকে রেখে আসেন গানেশ্বরের সিংহাসনে। 

শশাঙ্কের কর্তৃক মৃত্যুর খবর শুনে হর্ষবর্ধন ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এবং গৌড় রাজ্যকে পৃথিবী শূন্য করার ঘোষণা দেন । যাই হোক হর্ষবর্ধন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন।

৯. হর্ষবর্ধনের সাথে শশাঙ্কের সংঘর্ষ : তাই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন ভাই হর্ষবর্ধন। সিংহাসনে আরোহণের পর হর্ষ ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। 

পথিমধ্যে হর্ষবর্ধন শুনতে পান যে, বোন রাজ্যশ্রী বিন্ধ্য পর্বতে পালিয়ে আছে। বোনকে উদ্ধার করার জন্য হর্ষ বিদ্ধ্য পরর্তের দিকে যান এবং সেনাপতি ভক্তির অধীনে সৈন্যদল রেখে যান পরবর্তীতে হর্ষবর্ধন বোনকে উদ্ধারের পরে গঙ্গানদীর তীরে সেনাবাহিনীর সাথে আবার মিলিত হন। 

কিন্তু হর্ষবর্ধনের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল কি-না সে সম্পর্কে আর জানা যায়নি। কারণ হিউয়েন সাং ও বানভট্ট তাদের লেখায় এগুলো লেখেননি ।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে একথা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, শশাঙ্ক ছিলেন প্রাচীন বাংলার অন্যতম নরপতি যিনি সামন্তরূপে জীবন শুরু পরবর্তীতে বাংলার অধীশ্বর হন। 

শুধু বাংলায় নয় বাংলার বাইরেও তিনি তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। তাই প্রাচীন বাংলায় শশাঙ্কের উত্থান একটি আলোচিত ঘটনা বলাই চলে । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ