পাল শাসনামলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কিরূপ ছিল
পাল শাসনামলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কিরূপ ছিল |
পাল শাসনামলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কিরূপ ছিল
- অথবা, পাল শাসনামলে প্রাচীন বাংলার শাসনব্যবস্থার বিবরণ দাও।
- অথবা, পাল শাসনামলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বর্ণনা দাও।
উত্তর : ভূমিকা : সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত বাংলায় বিরাজ করছিল এক অন্ধকার যুগ। অরাজকতা বিশৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্রহীনতার অবসান ঘটিয়ে বাংলায় পালবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পালবংশের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসাধারণের উপর একধরনের আশীর্বাদ বর্ষিত হয়। আর বাংলায় এ আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসে পাল সাম্রাজ্যের প্রথম শাসক গোপাল।
তিনি সিংহাসনে আরোহণ করে তার অসাধারণ ভাস বুদ্ধি ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার দ্বারা সকল বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে বাংলায় দীর্ঘকাল শাসন করার জন্য পাল সাম্রাজ্যের পোড়াপড়া করেন।
বাংলায় পালবংশের উত্থান : শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তৎকালীন বাংলার একদিকে হর্ষবর্ধন ও অন্যদিকে ভাস্কর বর্মণের হাতে গৌড় রাজ্য প্রায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় কোনো শাসক ছিল না। সামন্ত রাজারা প্রত্যেকেই বাংলার সিংহাসন দখল করার জন্য একে অন্যর প্রতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শুরু হয় অবালকতা ও বিশৃঙ্খলা। বাংলার ইতিহাসে এই সময়টিকে অর্থাৎ সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত সময়টি 'মাৎস্যন্যায়" এর কালপূর্ণ হিসেবে খ্যাত।
এটা এমন এক অবস্থা যখন কোনো বিখি নেই শাসন নেই, শৃঙ্খলা নেই, বিচার নেই। মানুষের জীবন ছিল এক জঘন্য পশুতুল্য ও স্বল্পস্থায়ী এক জীবন। এ অবস্থা প্রায় ১০০ বছর চলে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বাংলার প্রধান নায়কেরা এবং সকল সাধারণ প্রজারা একত্রিত হয়ে গোপালকে রাজ পদে বরণ করে দেয়। আর গোপালের রাজত্ব গ্রহণের মধ্যে দিয়ে অষ্টম শতকে বাংলায় পালবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাল রাজত্বের প্রশাসনিক ব্যবস্থা : গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পালবংশের প্রশাসনিক তথা শাসনব্যবস্থা বাংলার জনজীবনে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল।
এ সম্পর্কে ড. আর.সি মজুমদার বলেন, “এ পাল সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তার লাভ হওয়ার সাথে সাথেই বাঙালির নতুন জাতীয় জীবনের সূত্রপাত হয়। পাল শক্তিই বাংলার অরাজকতা দূর করে বাংলাকে এক সর্বভারতীয় শক্তিতে পরিণত করে।
পাল যুগে প্রাপ্ত বিভিন্ন তাম্রশাসন ভূমি সংক্রান্ত দলিলপত্র ও বিভিন্ন লিপি থেকে এটা অনুমান করা হয় যে, পাল আমলে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা অনেকাংশে গুপ্ত যুগের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার ন্যায়।পাল যুগেই সর্বপ্রথম বাংলায় রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন হয়েছিল।
নিম্নে পাল যুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. সামন্ত প্রথা : পাল শাসনামলে সামন্ত প্রধার ব্যাপক প্রচলন ছিল। একথার সত্যতা আমরা বুঝতে পারি দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে সংঘটিত সামন্ত বিদ্রোহ এবং রামপালের সিংহাসন লাভে সামন্তদের সহায়তা।
এছাড়া খালিমপুর লিপি হতে জানা যায় সামন্তগণ ধর্মপালের রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে। সামন্ত রাজাদের মধ্যে শ্রেণিতেদ ছিল।
পাললিপি হতে সামন্তরাজাদের বিভিন্ন অভিধান ব্যবহার দেখা যায়। যথা- মহারাজা, রাজন রত্নিক, মহাসামন্ত ও সামন্ত ইত্যাদি।
পাল শাসকগণের মধ্যে কেউ এ সামন্ত রাজাদের যারা উপকৃত হয়েছে আবার কেউ তার সিংহাসন হারিয়েছেন। এছাড়া সাধারণ লোকজন সামন্ত রাজাদের অধীনে প্রায় সুখী ছিল।
২. রাজতন্ত্র : পাল সাম্রাজ্যে ছিল রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। এ রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজা প্রধান এবং সকল ক্ষমতার অধিকারী।
তার ক্ষমতার উপর কোনো সাংবিধানিক নিয়ম চলত না। তবে সর্ব সাধারণ একত্রিত হয়ে রাজ্যের কল্যাণে যোগ্য ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসানোর অধিকার ছিল।
এ রাজতন্ত্র ছিল বংশানুক্রমিক। গুপ্ত রাজাদের মতো পাল রাজাগণও বিভিন্ন ধরনের উপাধি গ্রহণ করতো।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপাধি হচ্ছে পরমতট্টারক, পরমেশ্বর, মহারাজাধিরাজ ইত্যাদি। সুতরাং বলা যায় পাল শাসনামল রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
৩. মন্ত্রিপরিষদ : প্রশাসনিক কাজ-কর্ম সমাধান করার জন্য পাল রাজত্বের একজন মন্ত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্ত্রি ছাড়া কোনো রাজতন্ত্র তার প্রশাসনিক কাজকর্ম সঠিকভাবে করতে পারে না।
তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে পাল প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। পাল যুগে মন্ত্রীরাও বংশানুক্রমিকভাবে মন্ত্রিত্ব পেত।
তবে একটি কথা সত্য যে, রাজার ক্ষমতা হ্রাস হওয়ার পিছনেও এ মন্ত্রিপরিষদ ও সামন্ত প্রথা ছিল একমাত্র কারণ।
৪. প্রশাসনিক বিভাগ : পাল শাসন আসলে প্রথম কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগ গড়ে ওঠে, যার অধীনে থাকত গুপ্ত যুগের মতো ভূক্তি, বিষয়, মণ্ডল ইত্যাদি প্রশাসনিক উপবিভাগ।
পাল সাম্রাজ্যকে শাসন সুবিধার জন্য কয়েকটি ভুক্তিতে ভাগ করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ভুক্তি হলো- নিহত ভুক্তি, বিহারের শ্রীনগর ভূমি বাংলায় ছিল পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি, বধর্মান ভুক্তি, পণ্ডভুক্তি প্রভৃতি ।
এছাড়াও মণ্ডল, ভাগ, আকৃতি, চতুরক ও পটক নামে ছোট ছোট প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব তুর্কির প্রধানকে বলা হতো উপরিক বা ভুক্তিপতি।
৫. গ্রামীণ শাসন : পাল শাসনামলের এসব ভুক্তির কোনো শাসক থাকত কি-না তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এ সময় দশ গ্রামিক শাসন পদ্ধতি চালু ছিল এবং প্রধানকে বলা হতো দশ গ্রামিক বা দশটি গ্রামের কর্তা মণ্ডলের নিচের বিভাগ ছিল গ্রাম। এসব গ্রাম শসন করতো গ্রামপতি। তিনি ছিলেন বাজার বেতনভুক্ত কর্মচারী।
৬. কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক বিভাগ : পাল শাসনামলে একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক বিভাগ থাকত। এই কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক বিভাপে বিভিন্ন পদধারী কর্মকর্তা থাকত।
এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- মন্ত্রী, সেনাপত্তি, বিষয়পতি, দত শক্তি, চৌৱন্ধৱনিক, দূত পদ্মাপমিক, বলাধ্যক্ষ্য প্রভৃতি কর্মকর্তা কর্মচারী সম্মিলিতভাবে শাসনব্যবস্থার ভার বহন করতো।
এ থেকে অনুমান করা হয় যে, পাল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ছিল সুশৃঙ্খল, বিধিবদ্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত। প্রত্যেক রাজার শাসন কাজ পরিচালনা করার জন্য আলাদা-আলাদা শাসন বিভাগ থাকত।
পাল রাজাদের প্রধান প্রধান প্রশাসনিক বিভাগ ও রাজকর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্ম বা দায়িত্ব সর্ম্পকে জানা যায় কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র থেকে।
এ প্রশাসনিক কাজে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য অর্মাতাদের সাহায্যে রাজা নিজেই এ বিভাগ পরিচালনা করতো।
এ বিভাগগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-
(i) অঙ্গরক্ষ : রাজার দেহরক্ষীর দায়িত্বে থাকতেন যে অমাত্য তাকে বলা হতো অঙ্গরক্ষ।
(ii) রাজস্থানীয় : রাজার রাজ প্রতিনিধি হিসেবে রাজস্থানীয় তার দ্বায়িত্ব পালন করতো।
(iii) দূত : দূত একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। রাজ্যর খবরাখবর এক রাজ্য হতে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করার দায়িত্ব থাকত এ দূত পদধারী কর্মচারীর উপর।
(iv) মহাসন্ধি বিগ্ৰহিক : রাজ্যর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্বে এ মহাসন্ধি বিগ্রহিক।
(v) ক্ষেত্রপ : ক্ষেত্রপ জরিপ বিভাগের অধিকর্তা।
(vi) মহাপটলিক : রাষ্ট্রীয় হিসাব, কিতাব, দলিল দস্তাবেজ ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন।
(vii) বিচার বিভাগ : বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন মহাসন্ত নায়ক। তিনি শুধুমাত্র রায়ের উপরে আপিলের বিচার করতেন। দন্ত নায়কের নিম্নস্তরের বিচারক ছিলেন দন্তনায়ক।
(viii) রাজস্ব বিভাগ : কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক বিভাগের অন্যতম একটি বিভাগ হলো রাজস্ব বা কর আদায় করা।
(ix) প্রতিরক্ষা বিভাগ : কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ ছিল প্রতিরক্ষা বিভাগ। এ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো মহাসেনাপতি বা মহাসেনাক্ষ্য।
পাল সৈন্যদের মধ্যে খস, হুন, কর্ণাট, বাঙালি এবং বিহারিরা ছিল। পাল সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ছিল, হস্তীবাহিনী, অশ্বারোহী ও নৌবাহিনী। এসব বাহিনীর জন্য আলাদা করে একজন অধ্যক্ষ থাকত। যেমন- নৌবাহিনীর জন্য নৌ অধ্যক্ষ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলায় পাল শাসন আমল দীর্ঘায়ু ছিল। এর পিছনে কাজ করেছে পাল সাম্রাজ্যের সুসংগঠিত এবং সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
এক সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই একটি জাতি তাদের উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে। পাল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য প্রায় চার শত বছরের শাসনামল তার জ্বলন্ত প্রমাণ ।