পাল ও সেন রাজত্বকালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
পাল ও সেন রাজত্বকালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর |
পাল ও সেন রাজত্বকালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, পাল ও সেন রাজত্বকালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল?
উত্তর : ভূমিকা : অতি প্রাচীনকাল থেকে বাংলা প্রাকৃতিক সু- সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি। যেন সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে সুনিপুণভাবে গড়েছেন বাংলার সু-সৌন্দর্যকে।
যেখানে যা প্রয়োজন ঠিক সেখানেই তা সঠিকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলার বুক চিরে বয়ে চলেছে বহু নদী আর সবুজ-শ্যামলের অপূর্ব এক সমারোহ।
প্রাচীনকাল থেকে বহু বংশ পর্যায়ক্রমে বাংলা শাসন করেছে এসব বংশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি রাজবংশ হচ্ছে পাল রাজবংশ এবং সেন রাজবংশ।
এ দুটি রাজবংশ দীর্ঘকাল বাংলা শাসন করেছিল। বাংলায় দুটি বংশের শাসনকালে অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
এর পিছনে কৃষির উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, বিভিন্ন ধরনের কুটিরশিল্পের বিকাশ বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থাকে সমৃদ্ধিশালী করেছিল।
পাল ও সেন রাজত্বকালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা : পাল ও সেন রাজত্বকালে বাংলার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ছিল বেশ সচ্ছল। এ দুটি রাজবংশের শাসনকালে বাংলার জনগণ ছিল অনেক সুখী।
জনগণের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলা ছিল না শান্তিপূর্ণ একটা পরিবেশ বিরাজ করেছিল। এসব বাংলার অর্থনৈতিক সচ্ছলতারই পরিচয় বহন করে।
নিচে প্রশ্নালোকে পাল ও সেন শাসনামলের অর্থনৈতিক অবস্থা একত্রে আলোচনা করা হলো-
১. কৃষির উন্নয়ন : বাংলা প্রাকৃতিক দিক থেকে একটি কৃষি প্রধান দেশ। তাই পাল ও সেন শাসন আমলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলভিত্তি ছিল কৃষি। এ কৃষির উপর ভিত্তি করেই তৎকালীন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল।
নিম্নে কৃষি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
(ক) কৃষিজাত দ্রব্যসামগ্রী : আবহাওয়া, জলবায়ু, মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং মাটি সবকিছুই বাংলার কৃষির অনুকূলে থাকায় বাংলায় বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হতো এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ধান, পাট, নীল, ইক্ষু, তুলা প্রভৃতি ছিল প্রধান।
এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলও বাংলায় উৎপাদিত হতো। এসব ফসলের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো।
(খ) চাষ পদ্ধতি : গরু অথবা মহিষে লাল দ্বারা মাটি চাষ করা হতো। নদী, পুকুর, খাল, বিল অথবা ডোবার পানি দ্বারা সেচ দেওয়া হতো।
এছাড়া চাষাবাদের জন্য অনেক সময় আকাশের বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হতো। আর জমি চাষের জন্য রাজাদের ভূমিকর দিতে হতো।
(গ) যন্ত্রপাতি : এ সময় কৃষি যন্ত্রপাতি বলতে তেমন কিছু ছিল না। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, কোদাল, কাস্তে, নিড়ানী, লাঙল প্রভৃতি কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছিল।
(ঘ) ভূমি জরিপ পদ্ধতি : পাল ও সেন শাসন আমলে এক প্রকার ভূমি জরিপ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। সেন শাসন আমলে ভূমি জরিপের জন্য নল ব্যবহার করা হতো। এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের নল ব্যবহার করা হতো।
(ও) পশুপালন : শাসন আমলে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পশুপালন। এ সময় আবাদি জি পাশাপাশি গোচারণ ভূমি ছিল।
আর গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছিল গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাতি ইত্যাদি। এসব পশু মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক চাহিল পুরণ করতো।
২. ব্যবসা-বাণিজ্য : পাল ও সেন শাসন আমলের ব্যাকা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রচলনের পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যবসা-বাণিজ বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছিল।
নিম্নে পাল ও সেন শাসনামলের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
(ক) অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য : যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম নদী হওয়ায় নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন নগর বা শহর। এ সময় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ছিল নদী এবং স্থলপথে।
পণ্য পরিবহনের জন্য তুলনামূলক সহজ ও ব্যয় কম হতো বিধায় বণিকগণ নৌপথেই পণ্য আনা নেওয়া করতো।
(খ) বৈদেশিক বাণিজ্য : পাল ও সেন শাসন আমলে বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। এ সময় চীন, সিংহল, আসাম, তিব্বত, নেপাল, ভুটান, ভারত প্রভৃতি দেশের সাথে বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রচলন ছিল।
(গ) বাণিজ্য দ্রব্যসামগ্রী : কৃষিজাত দ্রব্য ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করা হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কার্পাস, কার্পাসজাত বস্ত্রাদি, বিভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ম বস্ত্র, কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি প্রভৃতি বিদেশে রপ্তানি করা হতো। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মসলা এবং শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি করা হতো।
(ঘ) বিনিময় মাধ্যম : পাল ও সেন শাসনামলে ব্যবসা- বাণিজ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে মুদ্রা ও কড়ির প্রচলন ছিল। পাল শাসনামলের তামা ও রুপার মুদ্রা পাওয়া যায়, ধারণা করা হয় এসব মুদ্রা ব্যবসায়িক বিনিময়ের কাজে ব্যবহার করা হতো।
৩. শিল্পের বিকাশ : পাল ও সেন শাসন আমলের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল শিল্প। কৃষির মতো শিল্প ছিল অর্থনৈতিক জীবনের উপাদান। বাংলায় দুই ধরনের শিল্পের বিবরণ পাওয়া যায় । যথা :
(ক) বস্ত্র শিল্প : বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায় যে, পাল ও সেন যুগে বাংলার বস্ত্র শিল্পের অপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল। বাংলার মুসলিম সমগ্র পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত ছিল। এককথায় বলা যায়- তৎকালীন সময়ে বস্ত্র শিল্প বৃহৎ শিল্পের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
(খ) কুটিরশিল্প : পাল ও সেন শাসন আমলের কুটিরশিল্প অধিক পরিচিতি লাভ করেছিল। এসব কুটিরশিল্পের মধ্যে ছিল, চর্ম, তাঁত, মৃৎ বস্ত্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের জন্য নৌকা, শবই প্রভৃতি নির্মাণ করা হতো যা তৎকালীন সময়ে অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাল ও সেন আমল বাংলায় এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। আর এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ বিদ্যমান তা হলো তৎকালীন সময় বাংলা ছিল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ সমৃদ্ধিশালী।
কেননা এ সময় বাংলায় কোনো বিশৃঙ্খলা ছিল না তাই কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলার উন্নতিরই পরিচয় পাওয়া যায়।
সুতরাং একথা বলা যায় যে, পাল ও সেন শাসন আমলে বাংলা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি সমৃদ্ধিশালী বা স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ ছিল।
Ami kaj korte cai