পাল যুগের শাসন ব্যবস্থা আলোচনা কর
পাল যুগের শাসন ব্যবস্থা আলোচনা কর |
পাল যুগের শাসন ব্যবস্থা আলোচনা কর
- অথবা, পাল শাসনব্যবস্থার উপর প্রব রচনা কর।
- অথবা, পাল শাসনামলে প্রচীন বাংলার শাসনব্যবস্থার বিবরণ দাও ।
- অথবা, পাল যুগের শাসনব্যবস্থা কি সুবিন্যস্ত ছিল? এক্ষেত্রে তোমার মতামত কী?
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল রাজবংশ দীর্ঘকাল শাসন করেছে। সুশাসন, জনকল্যাণ, ধর্মীয় সহিতা, উন্নত জীবনবোধ ইত্যাদি বাংলায় সর্বপ্রথম পালরাই প্রতিষ্ঠিত করে।
পাল রাজারা বাংলা ও বিহার অঞ্চলে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় চারশত বছর শাসন করেছেন।
নৈরাজ্য ও চরম অরাজকতার হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করে গোপাল নামক এক উচ্চ বর্গীয় ব্যক্তি এই রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন ।
→ পাল যুগের শাসনব্যবস্থা : নিম্নে প্রশ্নালোকে পাল যুগের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
১. শাসন বিভাগ : পাল যুগে ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল প্রভৃতি শাসন বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। পালরাজারা প্রত্যক্ষ ভাবে সমগ্র বাংলাদেশ, বিহার, আসাম শাসন করেছে। এ যুগে পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি, বর্ধমান ভুক্তি, দণ্ড ভুক্তি ইত্যাদি বহুভুক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ।
২. রাজতন্ত্র : পাল রাজাদের আমলে বাংলায় রাজশক্তি সুদৃঢ় হয়। পাল যুগে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই প্রচলিত নিয়ম ছিল। শাসনব্যবস্থার কর্ণধার বংশানুক্রমিক রাজার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম।
গুপ্ত রাজাদের মতো পাল রাজারাও পরম ভট্টারক, পরমেশ্বর, মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করতেন। পাল শাসনব্যবস্থায় রাজপুত্র, যুবরাজ, রাজাভ্রাতারাও অংশ নিতেন। তারা প্রদেশে পাল ও অমাত্য হিসেবে কাজ করতেন।
৩. সামন্ত প্রথা : পাল যুগে বাংলায় সামন্ত প্রথার ভিত্তি গড়ে উঠে এবং সুদৃঢ় হয়। দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে সামস্ত বিদ্রোহ এবং ধর্মপালের কনৌজ দরবারে উপস্থিত হয়ে তার প্রতি বশ্যতা জানান ।
সামন্ত রাজাদের শ্রেণি বা স্তরভেন ছিল। পাল লিপিতে সামন্ত রাজাদের মহারাজা রাজন, রাজক, মহাসাম, সা প্রভৃতি অভিধায় তা প্রমাণ করে। দ্বিতীয় মহীপাল সামন্তচক্রের বিদ্রোহে সিংহাসনচ্যুত হন।
দিব্য ছিলেন একজন সামন্ত। রামপাল ১৩ জন প্রধান সামন্ত রাজার সামরিক সাহায্যে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে। কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে সামন্ত রাজাগণ স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করতেন এরূপ প্রমাণ রয়েছে।
৪. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা : পাল সাম্রাজ্যের শাসন প্রণালি বিধিবন্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল। রাজা, মন্ত্রী ও অমাত্যদের সাহায্যে কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালিত হতো।
অমাত্যদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন 'মহাসন্ধি বিগ্রহিক'। তিনি ছিলেন প্রধান অমাত্য। পররাষ্ট্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন 'দূত'।
রাজার প্রতিনিধি ও বাজার দেহরক্ষী ছিলেন 'রাজস্থানীয়' 'অঙ্গরক্ষ'। পিতার জীবদ্দশায় অনেক সময় যুবরাজ শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
৫. রাজস্ব বিভাগ : রাজস্ব বিভাগে বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত থাকতেন। উৎপন্ন শস্যের উপর ভিত্তি করে কর ধার্য করা হতো। যথাঃ ভাগ, ভোগ, হিরণ্য ইত্যাদি। রাজস্ব বিভাগে 'ষষ্ঠাধিকৃত' নামে এক শ্রেণি কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
এ ছাড়াও রাজস্ব বিভাগের অন্যান্য কর্মচারী ছিলেন যথাক্রমে 'চৌয়োদুরনিক' 'শৌদ্ধিক 'তরিক' ইত্যাদি। এরা বাণিজ্য অন্ধ, চৌর্য্যাদি অপরাধের জন্য অর্থনও ও খেয়ার মণ্ডল আদায় করতেন।
৬. সামরিক বিভাগ : সামরিক বিভাগের সর্বাধিনায়ককে বলা হতো সেনাপতি বা মহাসেনাপতি। পদাতিক, অশ্বরোহী, হস্তী ও রণতরী এ কয়েকটি ভাগে সামরিক বিভাগ বিভক্ত ছিল।
'কেরিপাল' দুর্গরক্ষক প্রান্ত পাল' (সীমান্তরক্ষক) প্রভৃতি অন্যান্য সামরিক কর্মচারীর নাম পাওয়া যায়। স্থলবাহিনী ছাড়াও পাল রাজাদের একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল।
দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে নৌবাহিনী, যুদ্ধের অন্যতম অঙ্গ ছিল। বহু প্রাচীনকাল হতে বাংলায় নৌবাহিনী খ্যাতি অর্জন করেছিল।
৭. গ্রামীণ শাসন : পাল শাসনামলে গ্রামীন শাসনব্যবস্থায় 'দশ্রামিক' ছিলেন দশটি গ্রামের কর্তা মণ্ডলের নিচের বিভাগ ছিল গ্রাম । গ্রামপতি গ্রাম শাসন করতেন।
৮. মন্ত্রিপরিষদ : পাল রাজত্বের সময় থেকেই রাজত্বের সমুদয় ব্যাপারে প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মন্ত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠে এ যুগে।
এতে প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। গর্ণ নামের একজন ব্রাহ্মণ ধর্মপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পাল রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
পাল রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীরা অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। পাল রাজ্যে অপর দুজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন 'যোগদেব' ও বৈদ্যদেব ।
৯. প্রশাসনিক অঞ্চল বিভাগ : পাল যুগেই বাংলায় প্রথম কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক বিভাগ গড়ে উঠে। যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনিক বিভাগ ভাগ করে সাম্রাজ্য শাসন করা হতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্ব হতে বাংলায় সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা পড়ে উঠেছিল পালরাজাদের আমলে তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এ শাসনব্যবস্থার উপর বৈদেশিক প্রভাব কি পরিমাণ ছিল তা নির্ণয় করা কঠিন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবজনক অধ্যায় হলো পালবংশের শাসনকাল ।