নসরত শাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর
নসরত শাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর |
নসরত শাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর
- অথবা, নসরত শাহের কৃতিত্বের বর্ণনা দাও।
- অথবা, নসরত শাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে কি জান তা আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যুর পর তার যোগ্য উত্তরসূরি নসরত শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি নিজ যোগ্যতাবলে বাংলার ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।
নসরত শাহ শাসন ক্ষেত্রে ব্যাপক দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি তার শাসন ব্যবস্থায় উদারনীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতিতেও অবদান রেখেছিলেন।
তিনি স্থাপত্য শিল্প ক্ষেত্রে বাংলায় ইলিয়াস শাহী। ধারাকে ধরে রাখেন। সর্বোপরি, একজন যোগ্য শাসকের গুণাবলি তার মধ্যে ছিল।
→ নসরত শাহের কৃতিত্ব : নসরত শাহ শাসক হিসেবে অনেকগুলো কীর্তি স্থাপন করেছেন। তার শাসনকালে পিতার প্রদর্শিত শাসননীতির প্রতিফলনই বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে তার নিজস্বতার পরিচয় মেলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
নিম্নে নসরত শাহের কৃতিত্ব বর্ণিত হলো :
১. যোগ্য উত্তরাধিকারী : নসরত শাহ ছিলেন হুসেন শাহের যোগ্য উত্তরাধিকারী। যোগ্যতা বলে পিতার জীবদ্দশায় তিনি | যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
তিনি প্রশাসনিক কিছু অধিকারও লাভ করেছিলেন। বিশেষ ক্ষমতাবলে তাকে নিজ নামে মুদ্রা জারি করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।
২. ভ্রাতাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার : নসরত শাহ বহুবিধ গুণাবলিতে ভূষিত ছিলেন। তিনি পিতার ঘোষণাবলে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি রাজা হবার পর নিজ ভ্রাতাদের সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করেননি।
তিনি অনর্থক সংঘর্ষ বা বিবাদ করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি ভ্রাতাদের সাথে স্নেহবৎসল ব্যবহার করেন এবং তাদের পদমর্যাদা ও ভাতা বৃদ্ধি করে দেন।
এর ফলে তার রাজত্বকালে ভ্রাতাদের সাথে ক্ষমতা নিয়ে কোন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি। তিনি তার উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের পুত্রকে নির্বাচিত না করে ভ্রাতাকে করেছিলেন বলে জানা যায়।
৩. বিদ্রোহী জোট গঠন : নসরত শাহের সময়ে দিল্লির লোদী সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময়ের উত্তর-ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য দিল্লির সম্রাজ্যের অধীনতা থেকে নিজেদের অধীনে বিভিন্ন অঞ্চল করায়ত্ত করতে থাকেন। এ অঞ্চলের বিদ্রোহীরা তাদের হারানো রাজ্য ফিরে পাবার আশায় বিদ্রোহ করতে থাকেন।
নসরত শাহ এসকল বিদ্রোহীদেরকে নিয়ে একটি জোট তৈরি করেছিলেন। তিনি এ সুযোগে আজমগড় পর্যন্ত তার রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন।
৪. ত্রিপুরার সাথে যুদ্ধ : নসরত শাহ ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। হুসেন শাহের রাজত্বকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল। নসরত শাহের সময়ে এসে এ যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল।
এ যুদ্ধে উভয় পক্ষই তাদেরকে যুদ্ধ বিজয়ী হিসেবে উল্লেখ করেছে। তাই এ যুদ্ধের ফলাফল আসলে কি হয়েছিল সে সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না।
৫. ত্রিহুত জয় : হুসেন শাহ ও সিকান্দর লোদীর মধ্যে একটি সন্ধি হয়েছিল। এ সন্ধির ফলে দুদেশ একেঅপরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযানে যায়নি। কিন্তু নসরত শাহ এ চুক্তি ভঙ্গ করে ত্রিহুত আক্রমণ করেন।
নিহতের রাজাকে পরাজিত ও নিহত করে তিনি উত্তর বিহারে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে বাংলার জন্য একটি বড় সফলতা অর্জিত হয়েছিল।
৬. আফগানদের আশ্রয়দান : ১৫২৬ সালে বাবর কর্তৃক ইব্রাহীম গোদী পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত হলে ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে। বাবর ভারতীয় রাজনীতিতে আগমন করে।
বাবর আফগানদের পরাজিত করে ভারতে স্বীয় সাম্রাজ্য স্থাপনে প্রশ্নসী হন। এ সময়ে পরাজিত আফগানরা নসরত শাহের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি আফগানদের আশ্রয় প্রদান করেন।
৭. বাবরের প্রতি আনুগত্য স্বীকার : ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বাবরের আগমন ঘটে শক্তির মহারণ হিসেবে। বাবর ভারতবর্ষের শক্তিশালী রাজাদের পরাজিত করেন।
১৫২৭ সালে বাবর নসরত শাহের কাছে মহর নামে একজন দূত প্রেরণ করেন তার মনোভাব জানার জন্য। নসরত শাহ বাবরের ক্ষমতা সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত না হলেও তিনি বাবরের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিলেন।
বাবরকে বাংলা আক্রমণের পরিকল্পনা থেকে বিরত রাখার জন্য তিনি বাবরের আনুগত্য স্বীকার করেন।
৮. আসামের সাথে যুদ্ধ : ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা কর্তৃক আসাম আক্রান্ত হয়েছিল। বাংলার সেনাপতি এ সময়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আসাম আক্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
দু'পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আসামের ৮ জন সেনাপতি নিহত হয়। বহু সৈন্য বাংলার সৈন্যদের হাতে মারা পড়ে। আসাম বাংলা কর্তৃক বিজিত হয়।
৯. পর্তুগিজদের অনুপ্রবেশে বাঁধা : নসরত শাহের রাজত্বকালে পর্তুগিজরা আরও একবার বাংলায় তাদের ঘাঁটি স্থাপনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। পর্তুগিজরা বাংলাতে জলদস্যু হিসেবে পরিচিত হয়।
পর্তুগিজরা বাংলাতে প্রবেশের চেষ্টা করলেও চট্টগ্রামের শাসক তাকে বাধা প্রদান করেন। চট্টগ্রামের শাসকের বাধার সম্মুখে তারা প্রতিরোধ রচনা করে।
এসময়ে চট্টগ্রামের শাসক কৌশলে পর্তুগিজদের দমন করেন। ফলে পর্তুগিজদের পক্ষে বাংলার প্রবেশ করা সম্ভব হলো না।
১০. গুজরাটের সাথে মৈত্রী স্থাপন : হুমায়ুনের বাংলা আক্রমণের আশংকায় নসরত শাহ গুজরাটের বাহাদুর শাহের সাথে মিত্রতা স্থাপনের জন্য দূত প্রেরণ করেন।
যেহেতু বাহাদুর শাহ মুঘল সম্রাটের শত্রু ছিলেন তাই তিনি এ মিত্রতা স্থাপন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে এ মিত্রতা স্থাপনের আগেই নসরত শাহ মারা যান ।
১১. ধর্মানুরাগী : নসরত শাহ ধর্মপ্রাণ মুঘলমান ছিলেন। গৌড়ে তিনি অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। নুসরত শাহ দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের নানা নিয়ম-কানুন মেনে চলতেন। তিনি ধর্মানুরাগী হিসেবে ইবাদতও পালন করতেন।
১২. সাহিত্য অনুরাগী : হুসেন শাহ একজন সাহিত্য অনুরাগী শাসক ছিলেন। তিনি পিতার মত সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এ সময়ে রচিত শ্রীকর নন্দী, কবিশেখের প্রভৃতি কবির কাব্যে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
১৩. স্থাপত্য শিল্পের অবদান : নসরত শাহ তার শাসনামলে অনেকগুলো স্থাপত্য কর্ম সম্পাদন করেন। বড় সোনা বা “বারো দুয়ারী” মসজিদ, ‘কদমরসূল মসজিদ'সহ তিনি অনেকগুলো স্থাপত্য কীর্তি স্থাপন করেন । তিনি অনেকগুলো প্রাসাদও নির্মাণ করেছিলেন।
১৪. রাজ্যসীমা : হুসেন শাহের মতো নসরত শাহের রাজ্যসীমাও বিস্তৃত ছিল। তার রাজ্যের আয়তন খুব বেশি ছিল।
প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ, ত্রিহুত ও বিহারের অধিকাংশ এবং উত্তর প্রদেশের কিয়দংশ নসরত শাহের অধিকারভুক্ত ছিল। ফলে তিনি একটি বিশাল রাজ্যের অধিকারী ছিলেন তা অনায়াসেই বলা যায় ৷
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, নসরত শাহ তার রাজত্বকালে পিতা হুসেন শাহের গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তিনি প্রথমদিকে পিতার ন্যায় রাজ্যবিস্তার নীতি গ্রহণ করেন এবং সফলতা লাভ করেন।
তবে তার রাজত্বের শেষ দিকে মুঘল শাসকদের আক্রমণে তিনি কিছুটা পর্যদস্ত হয়ে পড়েন। তবে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন বাংলার গৌরবকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন।
তাই নসরত শাহকে “The perfect successor of Husain Shah” (হুসেন শাহের যোগ্য উত্তরসূরি) বলা যায়।