নাসিরউদ্দিন নসরত শাহের শাসনকাল পর্যালোচনা কর
নাসিরউদ্দিন নসরত শাহের শাসনকাল পর্যালোচনা কর |
নাসিরউদ্দিন নসরত শাহের শাসনকাল পর্যালোচনা কর
- অথবা, সুলতান নসরত শাহের রাজত্বকাল আলোচনা কর।
- অথবা, নাসির উদ্দিন নসরত শাহের শাসনকাল সম্পর্কে যা জান বিশদ বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নসরত শাহ নাসিরউদ্দিন আবুল মুজাফফর নসরত শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি ছোটবেলা থেকেই যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন। ফলে তিনি রাজনৈতিক জটিলতা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। এই অর্জিত জ্ঞান তাকে রাজ্য শাসনে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
হুসেন শাহের রাজত্বকালে নসরত শাহ যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং পিতা কর্তৃক স্বনামে মুদ্রা প্রকাশের ক্ষমতাও প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
→ নসরত শাহের রাজত্বকাল : নসরত শাহ ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১৩ বছর রাজত্ব করেন। নানা কারণে তাঁর রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে নসরত শাহের রাজত্বকাল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রাজ্যবিস্তার : সুলতান নসরত শাহ যখন বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন, সেই সময় উত্তর ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হচ্ছিল।
দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদীর দুর্বলতার সুযোগে লোহানী ও ফার্মুলী আফগানরা পাটনা- জৌনপুর এলাকায় প্রায় স্বাধীন হয়ে উঠে।
দরিয়া খান লোহানী বিহারে স্বাধীনতা ঘোষণা করে লোহানী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে নসরত শাহ অগ্রসর হয়ে আজমগড় পর্যন্ত তার রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেন।
এরপর তিনি প্রায় সমগ্র উত্তর বিহার অধিকার করেন এবং তার আত্মীয় আলাউদ্দিন ও মখদুম আলমের উপর সেখানকার শাসনভার অর্পণ করেন। এভাবে নসরত শাহ তাঁর - রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
২. পর্তুগিজদের দমন : নসরত শাহের শাসনামলে পর্তুগিজরা প্রায়ই জলপথে লুন্ঠন করতো। এমনকি তারা বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা চালায়। নসরত শাহ পর্তুগিজদের কঠোরহস্তে দমন করেন এবং তাদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন।
৩. ত্রিহুত অধিকার : সুলতান নসরত শাহ স্নিহুতের রাজাকে পরাজিত করে ত্রিহুত অধিকার করেন। অতঃপর তিনি হাজীপুর অধিকার করে সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন।
৪. সম্রাট বাবরের সাথে সম্পর্ক : ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লির লোনী রাজবংশের অবসান ঘটিয়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।
মুঘলদের কাছে পরাজিত হয়ে পলায়নের পর আফগানরা বাংলায় নসরত শাহের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দে বাবরের সৈন্যবাহিনী গোগরা নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হলে আফগানরা পরাজিত হয়।
আফগানদের এ ব্যর্থতায় নরসত শাহ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। মুঘল বাহিনীর প্রতি নসরত শাহের মনোভাব জানার জন্য বাবর দিল্লি থেকে মোল্লা মুহাম্মদ মাজহাবকে দূত হিসেবে গৌড়ে প্রেরণ করেন।
বাবর ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে নসরত শাহের আনুগত্যের কথা জানতে পারেন এবং বাংলা অভিযানের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।
নসরত শাহ প্রচুর উপঢৌকনসহ ঈসমাইল মিতাকে দূত হিসেবে দিল্লি পাঠান। বাবরের সাথে নসরত শাহের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
৫. বাবরের সাথে সংঘর্ষ : এতদসত্ত্বেও নসরত শাহের পক্ষে মুঘলদের সাথে সংঘর্ষ পরিহার করা সম্ভব হয়নি। ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে আফগান নেতাগণ বাবরের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করে।
বাবরও সসৈন্যে বিহার অভিমুখে অগ্রসর হন। বাবর নিহত অধিকার করে গঙ্গা ও গন্ধকের সঙ্গমস্থলে জীবন ও বায়োজীদের অধীন আফগান সৈন্যদলকে পরাজিত করেন।
ফলে বাবুরের সৈন্যদল বাংলার সৈন্যদলের সম্মুখীন হয়। বক্সারের শিবির থেকে বাবব দ্রুত পাঠিয়ে নসরতের সৈন্য দলকে গোগরা নদীর তীর ত্যাগ করতে আদেশ দেন।
নসরত উত্তর দিতে বিলম্ব করেন। একমাস অপো করে বাবর পুনরায় নসরত শাহের কাছে দূত পাঠান। যুদ্ধ অনিবার্য ২. উঠল।
তিনদিনব্যাপী যুদ্ধ চলে। বাংলার পদাতিক, অশ্বারোহী ও নৌবাহিনী যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেও মুঘল, রণকৌশলের নিকট পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
ফলে গোগরা নদীর পূর্বতীরে বাবরের আধিপত্য স্থাপিত হয়। এ সময় বাবর কর্তৃক আরোপিত শর্তাবলি নসরত শাহ স্বীকার করে নেন।
৬. সম্রাট হুমায়ুনের সাথে সম্পর্ক : সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সম্রাট হুমায়ুন বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এ সময় নসরত শাহ মুঘল বিরোধী গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের সমর্থন লাভের আশায় মালিক মরজানকে দূত হিসেবে পাঠান বাহাদুর শাহ হুমায়ুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করছিলেন।
এই সংবাদ পেয়ে হুমায়ুন বাংলার বিরুদ্ধে আর অগ্রসর না হয়ে গুজরাট অভিমুখে যাত্রা করেন। নসরত শাহের আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলা- গুজরাটের মৈত্রী পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী না হলেও নসরত শাহের সময়োপযোগী কূটনীতি বাংলাকে আসন্ন যুদ্ধ থেকে রক্ষা করে।
মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে বাংলার মুসলিম রাজ্যকে যুদ্ধে লিপ্ত না করে | নসরত শাহ দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছিলেন।
৭. অহোম রাজ্য আক্রমণ : নসরত শাহ তাঁর রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ব্যস্ত থাকায় অন্যদিকে দৃষ্টি নিতে পারেননি। অহোম বুবনী থেকে জানা যায় যে, তাঁর রাজত্বের শেষ বছরে (১৫৩২ খ্রি.) তার মুসলিম সেনাপতি ভুরবক ৩০টি হাতি, ১,০০০টি ঘোড়া এবং বহু কামান নিয়ে অহোম রাজ্য আক্রমণ করেন।
তেমেনি দুর্গ বিনা বাধায় জয় করে ভুরবক অহোম রাজ্যের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি সিঙ্গরির সম্মুখে তাবু ফেলেন। অহোম রাজের পুত্র সুক্রেন একটি শক্তিশালী বাহিনী দুর্গ রক্ষার্থে সিঙ্গরি পৌঁছেন।
উত্তর পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যরা সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হলেও পরে তারা অহোমীয়াদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়।
৮. উড়িষ্যার সাথে সংঘর্ষ : নসরত শাহের সময় উড়িষ্যা সীমান্তেও কিছু সংঘর্ষ হয়েছিল। উড়িষ্যার রাজা প্রতাপ রুদ্র সেব म সম্প্রসারণে সচেষ্ট হলে এ সংঘর্ষ বাধে। তবে তার সাফল্য সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না।
৯. সুদক্ষ শাসক : নসরত শাহ পিতার মতোই উদার, সদাশয় ও সুদক্ষ শাসক ছিলেন। বাবরের আত্মজীবনীতে নসরত শাহকে উপমহাদেশের সমকালীন শাসকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি পিতৃরাজ্য অক্ষুণ্ণ রেখে তার রাজ্যসীমাও বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি যেভাবে রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেছিলেন ভাঙে তার সমর কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়।
নসরত শাহের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও উচ্চ কূটনৈতিক কৌশলের ফলে মুঘল সম্রাটদের আক্রমণ থেকে বাংলা নিরাপদ থাকে।
১০. মহানুভব : সুলতান নসরত শাহ মহানুভব সুলতান ছিলেন। তিনি ভাইদের সঙ্গে আচরণে যে সদ্ব্যবহার ও উদারতার পরিচয় দেন তার তুলনা বিরল।
সুলতান তার জীবদ্দশাতেই তাঁর তাই গিয়াসুদ্দিন মাহমুদকে নিজ নামে মুদ্রা প্রচলনের অনুমতি দেন। মুঘলদের দ্বারা বিতাড়িত আফগানদের আশ্রয় দান তাঁর চরিত্রের মানবিক গুণেরই বহিঃপ্রকাশ।
১১. নিষ্ঠাবান : মুখলমান সুলতান নসরত শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। তাঁর আমলে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও মাদ্রাসা | নির্মাণ করেন। তিনি রাসূল (সা.) এর পদচিহ্ন খচিত মর্মর পাথর মসজিদে স্থাপন করেছিলেন।
১২. শিল্পানুরাগী : সুলতান নসরত শাহ শিল্পানুরাগী ছিলেন। স্থাপত্য শিল্পে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। গৌড়ের বড় সোনা মসজ্জিল, কদম রসুল মসজিদ, ভবন বাঘা মসজিদ, নবগ্রাম মসজিদ প্রভৃতি তার অপূর্ব স্থাপত্য কীর্তির নিদর্শন। তিনি রাজধানীতে একটি তোরণ এবং কয়েকটি প্রাসাদও নির্মাণ করেন।
১৩. বিদ্যোৎসাহী নৃপতি : নসরত শাহ বিদ্যোৎসাহী নরপতি ছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উৎকর্ষ লাভ করে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কবি ও পণ্ডিতব্যক্তি তাঁর দরবারে সম্মান পেয়েছেন।
নসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অংশ বিশেষ এবং তার সময়েই সেনাপতি পরাগল খানের পুত্র ছুটি খানের নির্দেশে শ্রীকর নন্দী মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব বাংলায় অনুবাদ করেন।
জ্ঞান প্রসারের জন্য বিভিন্ন স্থানে গ্রন্থাগার স্থাপন তাঁর শিক্ষানুরাগের পরিচয় বহন করে। ফতেহাবাদে তার নিজস্ব গ্রন্থাগারও ছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার হুসেন শাহী বংশের অন্যতম শাসক ছিলেন সুলতান নসরত শাহ। নসরত শাহ তাঁর মহানুভবতা, সাহস ও কূটনীতি জ্ঞানের জন্য সমকালীন ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
দীর্ঘ তেরো বছর রাজত্ব করার পর ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে নসরত শাহের মৃত্যু হয়। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মনিষ্ঠা প্রভৃতি গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তার চরিত্রে। তার সুশাসনে বাংলা সমৃদ্ধ ও শান্তিময় অঞ্চলে পরিণত হয়।