মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও |
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও
- অথবা, মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার সামাজিক অবস্থা ততটা উন্নত ছিল না। তবে প্রাচীন বাংলার জনপদগুলো ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ।
তখন দেশের অধিকাংশ লোক কৃষি নির্ভর ছিল । অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত লোকের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না।
এ সময় সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য ও সংকীর্ণতা এবং কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল। এ প্রেক্ষাপটে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
→ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার সামাজিক অবস্থা : প্রাক-মুসলিম আমলে বাংলার সামাজিক জীবন ছিল অত্যন্ত সহজসরল ও সাধারণ। সামাজিক শ্রেণিভেদ থাকলেও মানুষের স্বভাব ছিল অমায়িক।
নিম্নে বাংলার সামাজিক অবস্থার বর্ণনা করা হলো :
১. সমাজব্যবস্থা : প্রাচীন বাংলার জনগণ দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা । আর্য ও অনার্গ। এদেশের প্রাচীন অধিবাসীরা কিরাত, নিষাদ, দামিল, পঙ্গু প্রভৃতির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট ধর্ম, দর্শন, যুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনীতি অবস্থা প্রচলিত ছিল। এভাবে মুসলিম বিজয়ের প্রাকালে আর্য ও অনার্য সংমিশ্রণে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
২. সমাজ বিন্যাস : বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে বাঙালি জাতির উদ্ভব। তাই প্রাচীন যুগে বাঙালির জীবনযাত্রা ছিল বিভিন্ন ধরনের। আর্যদের আগমনের পর থেকে বাংলার সমাজে জাতিভেদ প্রথার উৎপত্তি হয়।
প্রাচীনকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি শ্রেণির লোক ছিল । এদের বৃত্তিও ভিন্ন ভিন্ন ছিল।
৩. জীবনযাত্রা : প্রাচীনকালে বাংলার জনগণের জীবনযাত্রা ছিল। সহজসরল ও অনাড়ম্বর। প্রাচীন বাংলার ধর্মশাস্ত্রে সত্য, শৌচ, দয়া দান ইত্যাদি সকল গুণের মহিমা কীর্তন এবং ব্রাহ্মণ হত্যা, মদ্যপান, চৌর্যবৃত্তি ও ব্যাভিচার প্রভৃতি কঠিন পাপ বলে গণ্য করা হতো। তবে এরপরেও সমাজে দুর্নীতি ও অশ্লীলতা বিরাজমান ছিল।
৪. নারীর অবস্থা : প্রাচীন বাংলার নারীরা ছিল স্বল্পভাষিণী, অনুরাগিণী ও কোমলাঙ্গী। ড. নীহার রঞ্জন রায় এর দৃষ্টিতে নারীরা ছিল লক্ষ্মীর মতো কল্যাণী। স্বামীভক্ত এবং নারীত্বই ছিল প্রাচীন বাংলার চিন্তাদর্শ।
সমাজে বিধবার জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ। তাকে সর্বপ্রকার বিলাস বর্জন ও কৃচ্ছসাধন করতে হতো। পুরুষের বহু বিবাহ ও বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। নিষ্ঠুর সহমরণ প্রথা ও বিদ্যমান ছিল।
৫. উৎসবাদি : প্রাচীনকালে বাংলায় নানা রকম পূজা, আনন্দ-উৎসবের প্রচলন ছিল। ক্রীড়া, কৌতুক, নৃত্যগীত, অভিনয়, নৌকা বাইচ ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদও সে যুগে দেখা যায়। অনুপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক আচার অনুষ্ঠান তখন বাংলায় প্রচলিত ছিল।
বস্তুত, এ যুগে বাংলায় বারোমাসে তেরো পার্বণ অনুষ্ঠিত হতো এবং এ উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। তবে সে যুগে দুর্গা, অর্চনা শারদ্যোৎসব, হোলি উৎসব, পূজা পার্বণ বেশ প্রচলিত ছিল।
৬. খাদ্যদ্রব্য : প্রাচীনকালে বাংলার অধিকাংশ লোক গ্রাম বা পল্লিতে বাস করতো। ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজি, দুধ ও ফলমূল ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল।
তবে বাঙালির প্রিয় খাদ্য হিসেবে পিঠা, পায়েশের স্থান সবার উর্ধ্বে। এছাড়া মাদক পানীয় নিষিদ্ধ হলেও এ যুগে বাংলায় এর প্রচলন ছিল।
৭. পোশাক-পরিচ্ছদ : বাংলার নর-নারীরা সাধারণত ধুতি ও শাড়ি পরতো। পুরুষেরা মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরতো এবং তা হাঁটুর নিচে নামাতো না।
মেয়েদের শাড়ি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছাতো। ধুতি ও শাড়ি কেবল দেহের নিম্নার্থ আবৃত করতো। উৎসবাদিতে বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা ছিল।
নারীরা অঙ্গুরীয় কুণ্ডল, কণ্ঠহার, বালা, মল ইত্যাদি অলংকার পরতো। ধনীদের মধ্যে মণিমুক্তার ব্যবহারের প্রচলন ছিল।
৮. যোগাযোগ : প্রাচীন বাংলায় স্থল ও জলপথে গরুরগাড়ি ও নৌকা ছিল প্রধান বাহন। এছাড়া হাতি, ঘোড়া, পালকি প্রভৃতি ব্যবহৃত হতো।
বর্ষাকালে গ্রামে ভেলা ও ডোংগা ব্যবহার করতো। ছোট ছোট নদী-নালা, খালবিল ইত্যাদি পারাপারের জন্য সাঁকোর ব্যবস্থা ছিল।
৯. স্থাপত্যশিল্প : প্রাক মুসলিম যুগে বাংলার ভাস্কর্য স্থাপত্য ও চিত্রকলার ব্যাপক উন্নতি ঘটে। বৌদ্ধবিহার ও স্তূপের মধ্যে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হলো ময়নামতির শালবন বিহার, মহাস্থান গড়ের বসু বিহার এবং পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারের স্থাপত্য। এ যুগের স্থপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ধীমান, বীটপাল ও শূলপানি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাক-মুসলিম যুগে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা যথেষ্ট উন্নত না থাকলেও তা সমাজজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেনি।
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে এদেশীয় জনগণ দেশে উৎপাদিত পণ্য দ্বারাই তাদের চাহিদা মেটাতো। বিদেশেও তারা কিছু পণ্য রপ্তানি করতো।
জাতিভেদ প্রথা প্রকট আকার ধারণ করলেও তাদের সহজসরল অনাড়ম্বর জীবনব্যবস্থা ঐতিহাসিকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।