মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দাও
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দাও |
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দাও
- অথবা, মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা তত উন্নত ছিল না। তবে প্রাচীন বাংলার জনপদগুলো ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু।
তখন দেশের অধিকাংশ লোক কৃষিনির্ভর ছিল। অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত লোকের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না।
এ সময় সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য, সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল। এ প্রেক্ষাপটে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। .
→ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা : মুসলিম বিজয়ের পূর্বে প্রাচীন বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। তবে শহরগুলো ছিল শিল্প কারখানা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল।
আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রসার না ঘটলেও সে সময়কার অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল। নিম্নে প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করা হলো :
১. কৃষি : বাংলা চিরকালই কৃষিপ্রধান দেশ। প্রাচীনকালেও বাঙালির প্রধান উপজীবিকা ছিল কৃষি। প্রতি গ্রামে বস্তু জমি ছাড়াও কৃষি জমি ও গোচারণ জমি ছিল।
ধান, পাট, নীল, ইক্ষু, তুলা বাংলার প্রধান উৎপন্ন শয্য ছিল। এ সময় বহু ফলবান বৃক্ষ নিয়মিত চাষ হতো। এদের মধ্যে নারিকেল, সুপারি, আম, কাঁঠাল, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কৃষকগণ তাদের প্রয়োজনে গাভী, মহিষ, মেষ হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি পালন করতো। নদীমাতৃক বাংলার উর্বর মাটিতে কৃষিজাত দ্রব্যের প্রাচুর্য বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা প্রমাণ করে।
২. জমি জরিপ : এ যুগে নল দিয়ে জমি জরিপ করা হতো। বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে নলের দৈর্ঘ্য ভিন্ন রকমের ছিল।
৩. শিল্প : সে যুগে কৃষির মতো শিল্পও অর্থনৈতিক জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ ছিল। তখন ধাতু শিল্প, মৃৎশিল্প, কাষ্ঠ শিল্প, স্বর্ণকার, মণিকার প্রভৃতি শিল্পও উন্নতি লাভ করে।
বস্ত্রশিল্পের জন্যে বাংলাদেশ প্রাচীনকালেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। বাংলার কার্পাসজাত বস্ত্রাদি ভারতের সর্বত্র ও ভারতের বাইরে সমাদৃত ছিল।
কৌটল্যের “অর্থশাস্ত্রে” বাংলার কার্পাস বস্ত্রাদির প্রশংসা করা হয়েছে। সে সময়ে বাংলায় বিভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি হতো।
বাংলার মুসলিম আমলের মসলিন কাপড় ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সমগ্র জগতে বিখ্যাত ছিল। অতি প্রাচীনকালেই এর উদ্ভব হয়েছিল।
৪. কুটিরশিল্প : সে যুগে বাংলায় কুটিরশিল্পেরও অধিক প্রচলন ছিল। এর মাধ্যমে গ্রামবাসীদের প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই প্রস্তুত হতো। কুটিরশিল্পের মধ্যে বস্ত্রশিল্প, চর্মশিল্প, মৃৎশিল্প ও ধাতুশিল্প বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বিলাসিতার উপকরণ যোগানোর জন্য এ যুগে স্বর্ণকার, মণিকার প্রভৃতি শিল্পও প্রভূত উন্নতি লাভ করে। এছাড়াও কর্মকার ও সূত্রধর নৌকা, চাকার গাড়ি ইত্যাদি তৈরি করতো।
৫. ব্যবসা-বাণিজ্য : বাংলার কৃষিজাত এবং শিল্পোৎপন্ন দ্রব্যের প্রাচুর্যের ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নতি এবং প্রসার ঘটে। বণিকেরা সমুদ্র পথে ও স্থলপথে বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য করতো।
শ্রীপুর, ভুলুয়া, চন্দ্রদ্বীপ প্রভৃতি বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলের সাথে আরব ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল বলে বিভিন্ন বিবরণী হতে জানা যায় ।
৬. জলপথ : সে যুগে সমুদ্র পথে সিংহল, সুমাত্রা, ব-দ্বীপ, বোর্নিও, বার্মা, চীন, শ্যাম, সুমাত্রা প্রভৃতি দেশের সাথে বাংলার পণ্য বিনিময় চলতো।
৭. বিনিময় প্রথা : কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্য ক্রয়বিক্রয়ের জন্য বাংলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বড় বড় শহর, বন্দর, গঞ্জ ও হাট বাজার গড়ে উঠেছিল।
বিভিন্ন দ্রব্যাদির বিনিময়ের জন্যে “দিনার” এবং “রূপক” নামক স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রচলিত ছিল। পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে কড়িও ব্যবহৃত হতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাক-মুসলিম যুগে বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা যথেষ্ট উন্নত না থাকলেও তা সমাজজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেনি।
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে এদেশীয় জনগণ দেশে উৎপাদিত পণ্য দ্বারাই তাদের চাহিদা মেটাতো। বিদেশেও তারা কিছু পণ্য রপ্তানি করতো।
জাতিভেদ প্রথা প্রকট আকার ধারণ করলেও তাদের সহজসরল ও অনাড়ম্বর জীবনব্যবস্থা ঐতিহাসিকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।