মধ্যযুগের মুসলিম বাংলার ইতিহাসের উৎস সমূহ আলোচনা কর
মধ্যযুগের মুসলিম বাংলার ইতিহাসের উৎস সমূহ আলোচনা কর |
মধ্যযুগের মুসলিম বাংলার ইতিহাসের উৎস সমূহ আলোচনা কর
- অথবা, মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসের উৎসসমূহ পর্যালোচনা কর।
- অথবা, সুলতানি ও মুঘল আমলে বাংলার ইতিহাসের উৎসসমূহের বর্ণনা দাও।
- অথবা, মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের উৎসসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ইতিহাস তথ্য নির্ভরশীল। সুতরাং, কোনো দেশের বা জাতির ইতিহাস রচনা করতে গেলে প্রথমেই তথ্যাদি লাভের জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকারের মৌলিক উপাদান প্রয়োজন ।
প্রাচীনকালের বাংলার ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ রচনায় বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হন। কারণ সেসময় ইতিহাস রচনায় প্রখ্যাত তথ্যাদির চেয়ে পরোক্ষ তথ্যাদির উপর নির্ভর করতে হতো বেশি।
কিন্তু মধ্যযুগে সুলতানি শাসনামলে ইতিহাসচর্চা কিছু কম থাকলেও মুঘল আমলে ইতিহাস চর্চা বেশ ভালোই হতো। ইতিহাস রচনার প্রত্যক্ষ উপাদান পর্যাপ্ত থাকায় অন্য তথ্যের উপর খুব বেশি নির্ভর করতে হতো না ।
→ মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসের উপাদান : ইতিহাসের উৎস রচনা করতে গেলে মধ্যযুগে দুটি শাসক বংশের নাম পাওয়া যায়। যথা-
১. সুলতানি শাসকগণ ও
২. মুঘল শাসকগণ ।
১. সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাসের উৎস : সুলতানি শাসনামলের ইতিহাসের উৎসসমূহ। যেমন :
(ক) লিখিত উৎস,
(খ) অলিখিত উৎস ও
(গ) বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা ।
(ক) লিখিত উৎস : লিখিত উৎসগুলো সম্পর্কে নিচে ধারাবাহিক বর্ণনা করা হলো :
১. তবকাত-ই-নাসিরী : মিনহাজ উদ্দিন আবু উমর বিন সিরাজউদ্দিন আল জুজানী 'তবকাত-ই-নাসিরী' গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি মধ্যযুগের অন্যতম ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
২৩ খণ্ড সংবলিত গ্রন্থটি ১২৬০ সালে লেখা শেষ হয়। মুসলিম বাংলার শাসন ইতিহাস জানার জন্য 'তবকাত-ই-নাসিরী' অন্যতম।
২. তারিখ-ই-ফিরোজশাহী : অসাধারণ প্রতিভাবান ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাণী 'তারিখ-ই-ফিরোজশাহী' ও 'ফতওয়া-ই- জাহানদারী' গ্রন্থ দু'টি রচনা করেন।
বারানী ১৩৫৭ সালে তার গ্রন্থ 'তারিখ-ই-ফিরোজশাহী” রচনা শেষ করেন। তিনি বাংলায় কোনো সময় না আসলেও ঘটনাপ্রবাহ অতি ঘনিষ্ট মহল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
৩. তারিখ-ই-মোবারকশাহী : দিল্লির সৈয়দ সুলতানি মোবারক শাহের রাজত্বকালে ইয়াহিয়া বিন আহমদ বিন আবদুল্লাহ সরহিন্দী 'তারিখ-ই-মোবারকশাহী' রচনা করেন।
গ্রন্থটিতে সুলতান ঘুরী- ১৪২৪ সাল পর্যন্ত দিল্লির সুলতানদের ইতিহাস লিখিত আছে। এখানে বাংলার ইতিহাসও আলোকপাত করা হয়েছে।
৪. সিরাত-ই-ফিরোজশাহী : চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে "সিরাত-ই-ফিরোজশাহী" গ্রন্থটি রচিত। এ গ্রন্থে ফিরোজশাহ ভুখলকের বাংলা অভিযান বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
৫. ফুতুহাত-ই-ফিরোজশাহী : সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলক রচিত 'ফুতুহাত-ই-ফিরোজশাহী' গ্রন্থটি মধ্যযুগের ইতিহাসের অন্যতম উপাদান বিশেষ।
৫. মুস্তাখাব-উত-তাওয়ারিখ : বদায়ুনী 'মুন্তাখাব-উত- তাওয়ারিখ” গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি এ গ্রন্থে দিল্লি সুলতানদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বাংলার ইতিহাসের উপরও আলোকপাত করেন।
৭. কিরান-উস-সাদাইন : আমীর খসরু (ভারতের তোতাপাখি) এ গ্রন্থটির রচয়িতা। এ গ্রন্থে বলবনী শাসনামলের রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।
লখনৌতি তথা বাংলার শাসনকর্তা বুধবা খান ও তার পুত্র কায়কোবাদের মধ্যে যুদ্ধাংদেহী অবস্থান ও অতঃপর উভয়ের মিলন দৃশ্য এ গ্রন্থে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
৮. বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা : মরক্কোর পর্যটক আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ ওরফে ইবনে বক্তৃতা বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের রাজত্বকালে (১৩৪৫-১৩৪৬ সালে) বাংলায় আসেন।
ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে স্বল্প বর্ণনা রয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনা দূত মাহুয়ান সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে তিনবার বাংলা ভ্রমণ করেন।
চীনা প্রতিনিধি দলের সাথে তিনি দোভাষী হয়ে এসেছিলেন। তিনি বাংলা সম্পর্কে একটি বিবরণী লেখেন। বিবরণীতে বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেন।
৯. ভূগোলবিদগণের বর্ণনা : বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনার পাশাপাশি ভূগোলবিদগণের বর্ণনাও মধ্যযুগের সুলতানি আমলের ইতিহাসের উৎসের অন্যতম উপাদান।
সোলায়মান ভাজির ও আবু জায়েদ শিরকীর 'সিলসিলাহ আল-তাওয়ারিখ', খুরদেবার “কিতাব-আল-মাসালিক’, মাসুদীর 'মুরুজ্জসাল-জাহার', ইদ্রিসীর 'নজুহাত আল মুশতাক' প্রভৃতি গ্রন্থ ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১০. সুফিদের জীবনচরিত ও তাদের লিখিত চিঠি : সুফি সাহিত্য বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস প্রণয়নে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমীর খুরদের 'সিয়ার-আল-আউলিয়া' মাওলানা জামালীর 'সিয়ার-আল-আরিফিন', শেখ আব্দুল হক দেহলভীর 'আখবাব আল-আখিয়ার' উল্লেখযোগ্য সুফি সাহিত্য।
(খ) অলিখিত উৎস : সুলতানি আমলের অলিখিত উৎসগুলো হচ্ছে । ইতিহাস রচনার উৎস হিসেবে স্থাপত্য নিদর্শনের মূল্য অপরিসীম।
এসকল নিদর্শন সুলতাদের রুচি, রাজ্যের আর্থিক স্বচ্ছলতা, দেশের শিল্পে বিভিন্ন দেশের প্রভাব প্রভৃতির পরিচয় বহন করে।
মসজ্জিন, মাদ্রাসা, মন্দির অট্টালিকা ও সমাধি সৌধ হতে বিভ্রান্তিকর সন-তারিখের যথার্থ, সময়কাল জানা যায়। দাখিল দরওয়াজা, ষাট গম্বুজ মসজিদ এসময়কার।
শিলালিপি সর্বাপ্রেক্ষা মূল্যবান তথ্য দিয়ে থাকে। শিলালিপি থেকে শিলালিপি উৎকীর্ণকারীর নাম, পরিচয় ও তারিখ জানা যায়। অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার ও প্রশাসনিক বিভাগের নাম জানা যায় উৎকীর্ণ শিলালিপি হতে।
ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ও সোনারগাঁওয়ের ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস হচ্ছে মুদ্রা।
মুঘল আমলে ইতিহাসের উৎস : আলোচনার সুবিধার্থে ইতিহাসের উৎসকে আবার দুই ভাগ করা হয়। যথা-
(ক) লিখিত উৎস ও
(খ) অলিখিত উৎস।
(ক) লিখিত উৎস : 'আকবরনামা' গ্রন্থটিতে সম্রাট আকবরের শাসনামল সম্পর্কে সুন্দর বিবরণ দেওয়া আছে। আবুল ফজল গ্রন্থটি রচনা করেন। 'আইন-ই-আকবরী' এর তৃতীয় খণ্ড
১. তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী : সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর শাসনামল, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আইন ও সমকালীন মুঘল শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ উল্লিখিত আছে গ্রন্থটিতে।
২. ভবাকাত-ই-আকবরী : 'তবাকাত-ই-আকবরী' নিজাম উদ্দিন রচিত গ্রন্থ। আকবরের রাজনৈতিক বাদানুবাদ বিষয়ক তথ্য দ্বারা রচিত গ্রন্থ ।
৩. বাহারিস্তান-ই-গায়েবী : এ গ্রন্থটি সিতাব কর্তৃক গ্রন্থ রচিত। এ গ্রন্থে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। মির্জা নাথান ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন ও বাংলার মুসলিম রাজত্বকাল নিয়ে এ ইতিহাস গ্রন্থটি রচনা করেন।
৪. রিয়াজ-উস-সালাতিন : সৈয়দ গোলাম হোসেন সলিম ১৭৮৭ ১৭৮৮ সালে এটি রচনা করেন। এটি মৌলিক গ্রন্থ নয়। বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা, জলবায়ু, উৎপন্ন কৃষি ও শিল্প দ্রব্য সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আছে এ গ্রন্থে। 'ইকবালনামা' এসময় রচিত।
৫. 'তারিখ-ই-জাহানশাহী' : 'চাহার চামন', 'দস্তুরুল- আমল-ই-আওরঙ্গজেবী', 'দিভান পসনদ', 'মিরাট-ই-আহমদী প্রভৃতি মুঘল আমলের গুরুত্বপূর্ণ ফার্সি পাণ্ডুলিপি।
৬. আত্মজীবনী ও জীবনচরিত : 'বাবরনামা', 'জাহাঙ্গীরনামা', 'আকবরনামা', 'হুমায়ুননামা', 'তুযুক-ই-বাবরী', 'তুযুক-ই-জাহাঙ্গীর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ আত্মজীবনী ও জীবনচরিত। যেখানে ইতিহাসের উৎস বিরাজমান।
৭. সরকারি চিঠিপত্র ও নথিপত্র : এসকল চিঠিপত্র ও নথিপত্র আবিষ্কারের পর কর্মচারীদের বেতন, বেতনের হার, ছুটি, মঞ্জুি প্রশাসনিক সংস্কার ও রাজস্ব হিসাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ।
৮. পর্যটকদের বিবরণী : ইংরেজ, ওলন্দাজ, ইতালীয়, পর্তুগিজ পরিব্রাজকেরা এদেশে এসেছেন বিভিন্ন সময়ে। ফাদার মনসারেট, হকিন্স, টমাস রো, প্যালিট, টেরী, সারিট ও বার্নিয়ান প্রকৃতি পর্যটকেরা এদেশে এসেছেন এবং এদেশ সম্পর্কে সুন্দর বিবরণী রেখে গেছেন।
(খ) অলিখিত উৎস : মুদ্রা, শিলালিপি অলিখিত উৎস যেসকল তথ্য লিখিত উৎস থেকে পাওয়া যায় না, তা অলিখিত উৎস থেকে পাওয়া যায় ।
সমসাময়িক সাহিত্য : সমসাময়িক কিছু সংখ্যক মুসলিম লেখকের লিখিত গ্রন্থাবলির নাম দেওয়া হলো : শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা' জৈনুদ্দিনের 'রসুল বিজয়', কবি মুজাম্মিলের ‘সাতনামা' ও নছিহতনামা', দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লী- মজনু’ কবীরের ‘মধুমালতী' এবং হিন্দু কবি বিজয়গুপ্ত বংশীবদন, ক্ষেমানন্দ ও বিপ্রদাসের 'মনসামঙ্গল কাব্য'।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ ও গোবিন্দ দাসের চৈতন্য জীবনী' কাব্য। মুকুন্দ রাম, দ্বিজ হরিনাম ও অন্যান্যদের দ্বারা রচিত ‘চণ্ডীকা’ কাব্যসমূহ মুঘলমান যুগের সমাজ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে ।
উপসংহার : পরিশেষে একথা বলা যায় যে, ইতিহাস রচনায় সামগ্রিক উপাত্তের গুরুত্ব সমান। একটিকে বাদ দিয়ে সঠিক, যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।
তাই মধ্যযুগের বাংলার সত্যিকারের ইতিহাস রচনা করতে গেলে সে যুগের ইতিহাস রচনার বিভিন্ন প্রকারের উপাদানসমূহের সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন ।