মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের গুরুত্ব মূল্যায়ন কর
মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের গুরুত্ব মূল্যায়ন কর |
মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের গুরুত্ব মূল্যায়ন কর
- অথবা, মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে শিলালিপি ও মুদ্রার গুরুত্ব মূল্যায়ন কর ।
উত্তর : ভূমিকা : মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে উপাদানসমূহ খুবই সীমিত। সুলতানি আমলের লিখিত উৎস নাই বললেও চলে । মুঘল আমলে লেখা কিছু গ্রন্থ আছে।
তবুও সেগুলো দিল্লিকেন্দ্রিক। যেখানে বাংলা সম্পর্কে সামান্য কিছু লেখা আছে। ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য লিখিত বস্তুনিষ্ঠ গ্রন্থ কম থাকায় মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজ অনেকটা কষ্টকর।
তাই পরিপূর্ণ ইতিহাস রচনার জন্য লিখিত উপাদানের পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক বা অলিখিত উপাদান এর অবদান অনস্বীকার্য। অলিখিত উপাদানসমূহ বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজকে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করেছে।
ফলে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিরলস প্রচেষ্টায় আবিষ্কৃত প্রত্নতত্ত্বসমূহ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইতিহাস রচনার উৎস হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বা মুদ্রা ও শিলালিপির অবদান নিম্নে তুলে ধরা হলো :
→ মধ্যযুগের বাংলার উৎস হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বা মুদ্রা ও শিলালিপি : বাংলার মুঘলমান সুলতানগণ কর্তৃক উৎকীর্ণ সমসাময়িক অনেক শিলালিপি ও মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। সুলতান বা তার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ তদারকের মাধ্যমে মুদ্রা ও শিলালিপি উৎকীর্ণ হতো।
১. শিলালিপি : অধিকাংশ শিলালিপি ফারসি ভাষায় উৎকীর্ণ হতো। শিলালিপিতে সাধারণত কোরআনের আয়াত বা শ্লোক, হাদিস বা রাসুলের বচন, সুলতানের নাম ও পরিচয়, শিলালিপি উৎকীর্ণকারীর নাম, পরিচয় ও উৎকীর্ণের তারিখ থাকতো।
বাংলার মাটিতে লিখিত সুলতানি আমলের কোনো সমসাময়িক ইতিহাস পাওয়া যায় না। সেজন্য বাংলার সুলতানদের কার্যক্রম নির্ধারণ করা কঠিন।
কিন্তু শিলালিপি আবিষ্কারের ফলে বাংলার সুলতানদের কার্যক্রম নির্ধারণ করা সহজ হয়েছে। শিলালিপির প্রাপ্তি স্থানের সাহায্যে বিভিন্ন সময়ে মুসলিম রাজ্যের বিস্তৃতির সংবাদ পাওয়া যায়।
তদুপরি শিলালিপিগুলো সাধারণত মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, প্রাসাদ, পুল, কুয়া প্রভৃতি নির্মাণ বা খননের সময় উৎকীর্ণ হতো।
ফলে শিলালিপির সাহায্যে মুসলমান সমাজ | সম্পর্কে জানা যায়। কোনো কোনো শিলালিপিতে সুলতানদের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়।
সুলতানি আমলের অনেক উচ্চপদস্থ অফিসারের এবং প্রশাসনিক বিভাগের নাম শুধু শিলালিপিতেই পাওয়া যায়। কোন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় না।
২. মুদ্রা : মুদ্রায় সাধারণত কালেমা, চার খলিফার নাম, সুলতানের নাম ও পরিচয়, তারিখ এবং টাকশালের নাম উৎকীর্ণ হয়। মুদ্রার দুটো দিক আছে। যথা-
১. সামনের বা মূল দিক (Obverse) ও
২. উল্টোদিক বা পেছনের দিক (Reverse)।
সামনের দিকে থাকে রাজার নাম। উল্টো দিকে থাকে মুদ্রা উৎকীর্ণ হওয়ার তারিখ। যে খলিফার আমলে উত্তীর্ণ হয় সে খলিফার নাম থাকে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও প্রশাসনিক বিভাগের হদিস পাওয়া যায় মুদ্রা থেকে ।
যেমন : মুদ্রার "ধ্যে রাজ্যের জেলা, মহকুমা প্রভৃতি প্রশাসনিক স্তরের উল্লেখ থাকে। মুদ্রার প্রাপ্তিস্থানকে ধরে নেওয়া হয় সেটি ঐ রাজার রাজ্যভুক্ত এলাক।
ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতান আলাউদ্দীন ফিরুজ শাহ ও সোনারগাঁও এর সুলতান ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহের নাম কোন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় না, শুধু মুদ্রার মাধ্যমেই তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় ।
৩. সৌধ বা স্মৃতিগুপ্ত : সৌধ বা স্মৃতিস্তন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অন্যতম নিদর্শন। সৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ থেকে শাসকদের সম্পর্কে অনেক তথ্য লাভ করা যায়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইতিহাস লেখার বা পুনর্গঠনের দুটি উপাদান আছে। যথা-
১. লিখিত উপাদন ও
২. অলিখিত উপাদান।
এ অলিখিত উপাদান হলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যা ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজকে ত্বরান্বিত করে। শিলালিপি ও মুদ্রা আবিষ্কৃত না হলে বাংলার ইতিহাসের অনেক কিছুই অজানা থাকতো।
বিভিন্ন স্মৃতিস্তত্ত্ব, স্থাপত্য নিদর্শন, সৌধ, মুদ্রা ও শিলালিপি বাংলার উন্নত ও রুচিশীল সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিচ্ছবিকে ফুটিয়ে তুলে।
এগুলো রাজনৈতিক ইতিহাসকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। সুতরাং মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে বা রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব অনেক।