কৈবর্ত কারা ছিলেন । কৈবর্তদের পরিচয় দাও
কৈবর্ত কারা ছিলেন । কৈবর্তদের পরিচয় দাও |
কৈবর্ত কারা ছিলেন । কৈবর্তদের পরিচয় দাও
- অথবা, কৈবর্তদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলায় দীর্ঘকাল ধরে পাল রাজারা শাসন করেছেন। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন বলে মাছ ও মাংস ভক্ষণ করতেন না।
তাদের সময়ে একশ্রেণির লোক ছিল যারা মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করতো। এজন্য পাল রাজারা তাদের উপর দমনপীড়ন করতেন ও মৎস্য আহরণ করতে নিষেধ করতেন।
এ সকল মৎস্য আহরণকারীদের কৈবর্ত বলা হয়। তারা পাল রাজাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মহিপালের সময় বিদ্রোহ করে।
এজন্য কৈবত্যরা ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছেন। তাদের বিদ্রোহকে ভারতবর্ষের প্রথম সফল বিদ্রোহ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
→ কৈবর্তের শাব্দিক অর্থ : কৈবর্ত অর্থ ধীবর বা জেলে। নিষাদের ঔরসে আরোগজ্জাত জাতি বিশেষ কিম্বত দেশীয় রাজত্যু বা কৃষিকার জাতিকে কৈবর্ত বলে।
→ প্রকারভেদ : কৈবর্তদেরকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
১. ক্ষত্রিয়ের পরিণীতা : বৈশ্যা পত্নীর সন্তানের নাম কৈবর্ত বলে পরিগণিত হয়েছে ও নিষাদ জাতীয় পুরুষ আরোগজ্জাতীয় স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে যে সন্তান উৎপাদন করে তাদেরকে মার্গবখবা দাশ বলে।
আর্যাবর্তবাসিগণ এ জাতিকে কৈবর্ত নামেও অভিহিত করে থাকে। তারা নৌ কর্মজীবী অর্থাৎ নৌকাকে অবলম্বন করে মাছ শিকার করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
তারা সমাজে জেলে কৈবর্ত নামে অভিহিত হন। যারা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত তাদের হালিক বা জেলে কৈবর্ত বলা হয়।
২. কৈবর্ত সম্পর্কে পণ্ডিতদের মতামত : কৈবর্ত বলতে কাদেরকে সঠিকভাবে বুঝাবে তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ব্যাপক মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়।
নিম্নে এ সকল পণ্ডিতদের মতামত উপস্থাপন করা হলো :ড. এস.পি লাহিড়ী পতি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি কৈবর্ত বলতে চাষি কৈবর্ত বা বাংলার চাষি, কৃষক ও জমি মালিকদের বুঝিয়েছেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, “কৈবর্তরা ছিল বাংলার শক্তিশালী যুদ্ধপ্রিয় ও কৃষিজীবী প্রিয়ারসন তার 'বেঙ্গল গেজেটিয়ারে' বলেছেন যে, বাংলার সাহিত্য ও চাধি কৈবর্ত সমার্থক। এরাই ছিল বাংলার প্রকৃত ক্ষত্রিয় এবং জমির মালিক ও কৃষক সম্প্রদায়।
ড. বিনয়চন্দ্র সেন কৈবর্ত বলতে ত্যাগি কৈবর্ত বা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কে মনে করেন। তাঁর মতে, বৌদ্ধ পাল রাজাদের অহিংস নীতির জন্য মৎস্যজীবী কৈবর্তদের জীবিকার অসুবিধা হয় কৈবর্ত সম্প্রদায় অসন্তুষ্ট ছিল।
সুরপাল ও রামপাল বন্দি হলে সামন্ত শ্রেণি দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এ সুযোগে কৈবর্ত নেতা দিব্য ক্ষমতা অধিকার করেন।
ড. নিহার রঞ্জন রায়ও কৈবর্তদের মৎস্যজীবী বলেছেন।
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫০ সালে এ সম্পর্কে নিহাররঞ্জন রায়ের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করায় বাংলার সাহিত্য সম্প্রদায় অসন্তোষ প্রকাশ করে।
উত্তর বাংলার দিব্য অনুসন্ধানে সমিতির মাহিষ্য সদস্যরা একসময় এ মতবাদ প্রচার করেন যে, দিব্য ছিলেন তাদের সম্প্রদায়েরই লোক।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে কৈবর্ত । নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, কৈবর্তরা চাষি কৈবর্ত শ্রেণির লোক ছিল এবং রাজ্যপালের আমল থেকে রামপালের পূর্ব পর্যন্ত তারা বাংলায় বেশ প্রভাবশালী শ্রেণি ছিলেন।
দিব্যও এ সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার এক প্রধান সামন্ত ও দরবারের প্রভাবশালী লোক। হয়তো তিনি যশোদাসের পরিবারের লোক ছিলেন।
এ সম্প্রদায়ের যশোদা-মন্ত্রী নিযুক্ত হন। কারণ ভাতুরিয়া যশোদাসকে "ভূসৈজা' বলা হয়েছে। 'ভূসৈছ' শব্দটি চার্জি কৈবর্ত শব্দের সমার্থক এবং দাস প্রভৃতি উপাধি কৈবর্ত সমাজে প্রচলিত ছিল ।
এ মতের বিরুদ্ধে বলা হয় যে, ভূজে কথার অর্থ চাষি নাও হতে পারে। দাস পদবি বৈদ্য কায়স্থরাও ব্যবহার করতো।
অপরদিকে, ড. আব্দুল মোমিন চৌধুরী ও ড. বিনয়চন্দ্র সেন প্রদত্ত ব্যাখ্যার বিরোধিতা করে বলেছেন যে, পাল রাজারা সাধারণত সকল সম্প্রদায়ের প্রতি উদার মনোভাব দেখাতেন।
তখন মহাযান বৌদ্ধমত ভযান, কালযান চক্র প্রভৃতিরূপে প্রায় হিন্দুধর্মের কাছাকাছি চলে এসেছিল। সুতরাং দ্বিতীয় মহীপাল বৌদ্ধ ছিলেন বলে অন্য সম্প্রদায়ের উপর মনে করা হয় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, কৈবর্তনের পরিচয় নিয়ে৷ পণ্ডিতমহলে বিভিন্ন মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে কেউ বলেছেন কৃষক কেউ বলেন জেলে। তাদের উৎপত্তি স্থল সম্পর্কেও ঠিক র দুরূহ হয়ে পড়েছে।
তবে ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, রাজা মহিপালের সময় জেলেরাই বিদ্রোহ করেছিল মৎস্য শিকারের জন্য কারণ মহিপাল তাদের মৎস্য শিকারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল আর একারণেই বলা যায় যে, কৈবর্তরা জেলে বা মৎস্য শিকারি ছিলেন। তথা এভাবে তাদের জীবিকানির্বাহ করতেন।