খালিমপুরের তাম্রলিপিতে ধর্মপালের রাজ্য বিস্তার ও কনৌজের দরবারের পরিচয় দাও
খালিমপুরের তাম্রলিপিতে ধর্মপালের রাজ্য বিস্তার ও কনৌজের দরবারের পরিচয় দাও |
খালিমপুরের তাম্রলিপিতে ধর্মপালের রাজ্য বিস্তার ও কনৌজের দরবারের পরিচয় দাও
- অথবা, খালিমপুর তাম্রশাসনে ধর্মপালের কি রকম পরিচয় পাওয়া যায়। ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে তাঁর কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
উত্তর : ভূমিকা : সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায় উৎসের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস আমরা জানতে পারি কিছু লিখিত এবং অলিখিত উৎসের মাধ্যমে।
অলিখিত উৎসের মধ্যে রয়েছে তাম্রলিপি এবং তাম্রশাসন। এসব উৎসগুলো সংরক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন জাদুঘরে।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানার জন্য এমনি গুরুত্বপূর্ণ খালিমপুর তাম্রলিপি। এ থেকে আমরা ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার ও রাজত্বকাল সম্পর্কে জানতে পারি ।
→ ধর্মপালের পরিচয় ও সিংহাসনে আরোহণ : ধর্মপাল প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে তার কৃতিত্বের দ্বারা। ধর্মপালের পিতা ছিলেন (পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা) গোপাল এবং তার মাতার নাম ছিল দেদ্দাদেবী।
তিনি তার পিতা গোপালের মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন অনুমানিক ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে। গোপাল বাংলা ও বিহারের একাংশে যে পালবংশের ভিত্তি স্থাপন করেছিল তার উপর ভিত্তি করে তিনি এক শক্তিশালী নরপতি হিসেবে পরিণত হন।
খালিমপুর তাম্রলিপিতে ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার কনৌজের দরবার : আমরা ধর্মপালের রাজ্য বিস্তার ও কনৌজের সরবার সম্পর্কে জানতে পারি খালিমপুর তাম্রলিপি থেকে।
প্রতিহার রাজবংশের রাজা বৎসরাজ এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকুট রাজবংশের রাজা ধ্রুবধারাবর্যের উভয় শক্তির সামরিক দুর্বলতার সুযোগে ধর্মপাল উত্তর ভারতের কিছু স্থান অধিকার করেন।
এছাড়া ভাগল পুর তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে ধর্মপাল কনৌজের সিংহাসন থেকে ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করেন এবং কনৌজের সিংহাসনে চক্রাধকে বসান।
তাকে নিজের হাতের পুতুল হিসেবে ব্যবহার করেন। চক্রাধ ধর্মপালের একজন সামন্তরাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করে রাজত্ব করেন।
এছাড়াও ধর্মপাল উত্তর ভারতের অনেক এলাকা অধীনস্থ সামন্তসের দ্বারা শাসনের নীতি গ্রহণ করেন। ধর্মপাল উত্তর ভারতের অনেক অঞ্চল জরা করে কনৌজের রাজ দরবারে অনুষ্ঠান করেন।
খালিমপুর লিপিতে বলা হয়েছে এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারা উপস্থিত হয়ে ধর্মপালের বশ্যতা স্বীকার করেন।
খালিমপুর লিপিতে ধর্মপালের আধিপত্য বিস্তারের কথা উল্লেখ আছে এ বিষয়ে ড, মোমিন চৌধুরীও অভিমত প্রদান করেছেন। এছাড়া তিনি বলেন, ধর্মপালের এত বড় রাজ্য জয় করা সম্ভব ছিল না।"
ড. আর সি. মজুমদার বলেন, সমসামরিক উৎসের মধ্যে খালিমপুর লিপি অন্যতম। এ লিপির তথ্যগুলো বিশ্বাসযোগ্য। এ লিপিতে উল্লেখ আছে যে, ধর্মপাল বাংলা ও বিহার ব্যতীত সমগ্র সাম্রাজ্য প্রত্যক্ষভাবে শাসন করতেন না।
তিনি বাংলা ও বিহারকে তার সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলে মনে করতেন। এছাড়া পাঞ্জাব থেকে মালব, রাজপুতনা ও কনৌজে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসন বিদ্যমান ছিল। এসব অঞ্চলের সামন্ত রাজারা তার প্রতি অনুগত্য প্রদর্শন করতো।
ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ : ধর্মপাল এমন একটি সময় বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন, যে সময় উত্তর ভারতে কোনো শক্তিশালী রাজা ছিল না।
তাই উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে পাল প্রতিহার এবং রাষ্ট্রকূট বংশের মাধ্য যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাই ইতিহাসে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ নামে পরিচিত। ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা-
প্রথম পর্যায় : প্রথম পর্যায় সংঘর্ষের সূচনা হয় পালবংশের রাজা ধর্মপাল ও প্রতিহার রাজা বৎসরাজের সাথে ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে। এ সংঘর্ষে ধর্মপাল বৎসরাজের নিকট পরাজিত হন।
অমোঘবর্ষের সঞ্জন তাম্রশাসন ও সুরাটের বারদান থেকে জানা যায়, ধ্রুবধারাবর্ষ এবং বৎসরাজের মধ্যে আরও একটি যুদ্ধ সংঘঠিত হয় গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে।
দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজা ধ্রুবধারাধ্য ধর্মপাল ও বৎসরাজকে পরাজিত করেন। তিনি উত্তর ভারত জয় করার পর ইন্দ্রায়ুধকে গুপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে সিংহাসনে বসিয়ে আবার দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান।
তিনি ফিরে যাওয়ার পর ধর্মপাল ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ইন্দ্রাধকে পরাজিত করে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। এছাড়াও খালিমপুর লিপি থেকে জানা যায় তিনি কনৌজও অধিকার করেন।
সেড্ডিলের উদয় সুন্দরী কথা গ্রন্থে ধর্মপাল উত্তরপথস্বামী হিসেবে উল্লেখ করেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিগণ বলেন, ধর্মপাল কনৌজ আক্রমণ করলে অন্যান্য রাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়।
দ্বিতীয় পার্যায় : দাক্ষিণাত্যের রাজা ধ্রুবধারাবর্ষ ফিরে যাওয়ার পরে ধর্মপাল উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে।
বৎসরাজের মৃত্যুর পর তার ছেলে নাগভট্ট সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং বিভিন্ন রাজাদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করেন।
বারদান ও গোয়ালিয়র লিপি থেকে জানা যায় নাগভট্ট তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ধর্মপালের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এ যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন।
কিন্তু নাগভট তার পিতার মতোই ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ পাননি। কারণ রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজা তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারত আক্রমণ করে নাগভট্টকে পরাজিত করে। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি খুব সম্ভবত ৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মপালকে সাহায্যে করে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান।
তৃতীয় পর্যায় : প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় উৎসের অভাব রয়েছে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই উৎসের অভাব থাকায় আমরা তৃতীয় পর্যায় সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারি না।
ঐতিহাসিকদের মতে, তৃতীয় গোবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে যাওয়ার পর ধর্মপাল উত্তর ভারত আক্রমণ করে বিনা বাধায় সবকিছু দখল করে নেয়।
→ ধর্মপালের কৃতিত্ব : ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে ধর্মপাল যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা তাকে ইতিহাসে আরও বিশেষায়িত করে রেখেছে। তৃতীয় গোবিন্দ ফিরে যাওয়ার ফলে উত্তরের সিংহাসনে যে শূন্যতা দেখা দেয় তার সুযোগে ধর্মপাল তার লুপ্ত ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
সম্ভবত তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে আর কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয়নি। এভাবে ধর্মপাল বাংলার একটি প্রাদেশিক রাজ্যকে এক উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করেন।
ড. মজুমদারের মতে, ধর্মপালের রাজত্বকে বাঙালি জীবনে 'সুপ্রভাত' বলা চলে। শশাঙ্ক কনৌজ জয় করে তার অধিকার রাখতে পারেনি। এক্ষেত্রে ধর্মপাল সফল হয়েছেন। তিনি তার সামন্ত চক্রাধকে সিংহাসনে বসান ।
সোড্ডলের মতে, ধর্মপাল ছিলেন 'উত্তরপথস্বামী' খালিমপুর লিপির তথ্য অনুসারে ধর্মপাল তার বিশাল সাম্রাজ্য নিজ বাহুবলেই বিস্তার করেন। তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারত থেকে চলে গেলে তিনি তার হারানো গৌরব আবার পুনরুদ্ধার করেন।
ধর্মপাল তার অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তার রাজত্বকালে যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তা ইতিহাসে তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মপাল ছিল প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। যিনি তার সামরিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা এবং কূটকৌশল দ্বারা ছোট একটি রাজ্যকে এক বিশাল রাজ্যে রূপান্তর করেন।
ধর্মপাল সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি সমসাময়িক লিপির মাধ্যমে। এসব লিপির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি লিপি হচ্ছে খালিমপুর তাম্রলিপি।
যা থেকে আমরা ধর্মপাল সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারি। তাই অবশ্যই খালিমপুর তাম্রলিপি সমকালীন একটি বড় ঐতিহাসিক উৎস।