কররানী বংশের শাসক সোলায়মান কররানীর শাসন সম্পর্কে আলোচনা কর
কররানী বংশের শাসক সোলায়মান কররানীর শাসন সম্পর্কে আলোচনা কর |
কররানী বংশের শাসক সোলায়মান কররানীর শাসন সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, কররানী বংশের শাসক সোলায়মান কররানীর শাসন সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে কররানী বংশের শাসনামল একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তারা ছিলেন আফগান বা পাঠান জাতির একটি শাখা ৷
ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ট বলেন, “শেরশাহ ও তার পুত্র ইসলাম শাহ কর্তৃক আফগান গোত্র বওজীপুর রাজ্য ও খাওয়াসপুর তান্ডার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল লাভ করলে তারা অদ্ভুতভাবে একটি পৃথক বংশের সূচনা করে।”
কররানী বংশে একজন অন্যতম শাসক ছিলেন সোলায়মান কররানী। তিনি তাজ খানের মৃত্যুর পর ১৫৬৫ সালে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন সুযোগ্য শাসক ও সুদক্ষ বিজেতা ।
সোলায়মান কররানীর শাসনব্যবস্থা : নিয়ে সোলায়মান কররানীর শাসন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রাজধানী স্থানান্তর : তাজ খানের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা সোলায়মান কররানী বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করে বঙ্গে শান্তি স্থাপনের জন্য সচেষ্ট হলেন।
তিনি সর্বপ্রথমে গৌড় হতে মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণ- পূর্বে অবস্থিত তাণ্ডায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
২. শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন : সোলায়মান কররানী ছিলেন একজন সুযোগ্য শাসক ও সুদক্ষ বিজেতা। তার সময়ে অসংখ্য সামরিক বেসামরিক আফগান বাংলায় এসে তার আশ্রয় গ্রহণ করলে তিনি তাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন।
ঐতিহাসিক জন স্টুয়ার্ট এর মতে “সোলায়মানের অধীনে ৩৮শ হাতি, ৪০শ অশ্বারোহী সৈন্য, ১৪ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ২শ কামান ছিল।"
৩. মুঘলদের সাথে মিত্রতা স্থাপন : তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ। ড. আব্দুল করিম বলেন, "মুঘলদের সাথে এমন ব্যবহার করেন যাতে মুঘলরা তার বিরুक যদিও তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলার সার্বভৌম শাসক ছিলেন তথাপি মুঘল সম্রাট হুমায়ূন ও আকবরের নিকট উপহারসামগ্রী প্রেরণ করেন।
তিনি সুলতান উপাধিও গ্রহণ করেন নি। এমনকি তিনি আকবরের নামেই খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করেন। তাই ড. করিম বলেন, “এভাবে তিনি মুঘলদের সম্প্রসারণ নীতি হতে বাংলা-বিহারকে বাঁচিয়ে রাখেন।
J. N. Sarker বলেন, “In his foreign relations he was equally successful." Ref. The history of Bengal, Vol-II-P-182."
৪. উতি বা মুঘলমান : সুলতানদের মধ্যে একমাত্র সোলায়মান ফারানীই উড়িষ্যা জয় করতে সক্ষম হন। উড়িষ্যার রাজ মুকুন্দ হরিচন্দন পন, তক ইব্রাহিম খান শূরকে আশ্রয় দিলে সোলায়মান তার পুত্র বায়েজিন ও সেনাপতি কালাপাহাড়কে উড়িষ্যা বিজয়ে প্রেরণ করেন।
তারা ১৫৬৭ সালে পুরীসহ সমগ্র উড়িষ্যা অধিকার করেন। উড়িষ্যা বিজয় সম্পন্ন করে সোলায়মান শুধু নিজের মর্যাদাই বৃদ্ধি করেননি; বরং অফুরন্ত ধন-রত্নও লাভ করেন ।
৫. কুচবিহারের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন : ১৫৬৮ সালে কুচবিহার রাজ্যের নরনারায়ণ ও তার ভ্রাতা শুকলাধ্বজ বাংলা আক্রমণ করে। সোলায়মানের সাথে যুদ্ধে কুচবিহারের রাজা পরাজিত হন।
মুঘলমানগণ ব্ৰহ্মপুত্র হতে তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে এবং কামাখ্যা, হাজো ও অন্যান্য স্থানের মন্দিরগুলো বিধ্বস্ত করে।
তবে ইতোমধ্যে বাংলায় মুঘল আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলে কুচবিহারের রাজার সাথে তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করে।
৬. জগন্নাথ মন্দির বিধ্বস্ত : সোলায়মান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড় পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দির লুণ্ঠন করেন। সেনাপতি কালাপাহাড় প্রবলবেগে আক্রমণ করলে সেখানকার জ বিনাযুদ্ধে মুঘলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
ঐতিহাসিক নেয়ামতুল্লাহ বলেন, “জগন্নাথ মন্দির বিধ্বস্ত করে বহু মূল্যবান অলংকারে সজ্জিত শ্রীকৃষ্ণের প্রতিমূর্তি-যার চক্ষুযুগল ছিল হীরকের এবং অঙ্গ ছিল স্বর্ণের-এসব কিছু লুট করে নেওয়া হয়।
৭. মুঘলদের সাথে মিত্রতা স্থাপন : সোলায়মান কররানী একজন দক্ষ কূটনীতিবিদ ছিলেন। তিনি মুঘল সম্রাট হুমায়ুন ও আকবরের নিকট উপহারসামগ্রী প্রেরণ করে মিত্রতা স্থাপন করেন।
তাই ড. আব্দুল করিম যথার্থই বলেন, “তিনি এভাবে মুঘলদের সম্প্রসারণ নীতি হতে বাংলা বিহারকে বাঁচিয়ে রাখেন।”
৮. শাসক হিসেবে : সোলায়মান কররানী ছিলেন একজন দূরদর্শী ও সুদক্ষ শাসক। তার শাসন ব্যবস্থায় ইসলামি জীবন বিধান কঠোরভাবে অনুসৃত হয়।
তিনি দিনের নির্দিষ্ট সময়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক। দরবেশ ও পণ্ডিতগণ তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতেন ৷
মালদহের সোনা মসজিদটিও তিনি নির্মাণ করেন। তিনি অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক আফগানদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করেন।
ড. আব্দুল করিম বলেন, “মুঘল ও আফগান ঐতিহাসিকরা এবং বিদেশি পর্যটকরাও সোলায়মানের রণসম্ভারের প্রশংসা করেছেন।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার কররানী বংশের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হলেন সোলায়মান কররানী। তিনি কররানী বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক।
তিনি মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেও বাংলার সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী শাসক।