কবির ও নানকের পরিচয় দাও। সমকালীন হিন্দু মুসলিম সমাজে তাদের প্রভাব আলোচনা কর
কবির ও নানকের পরিচয় দাও। সমকালীন হিন্দু মুসলিম সমাজে তাদের প্রভাব আলোচনা কর |
কবির ও নানকের পরিচয় দাও। সমকালীন হিন্দু মুসলিম সমাজে তাদের প্রভাব আলোচনা কর
- অথবা, কবির ও নানকের সম্পর্কে লিখ। সমকালীন হিন্দু-মুসলিম সমাজে তাদের প্রভাব বর্ণনা কর।
উত্তর : · ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে যাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কবির ও নানক। গুরু নানক ছিলেন শিখ ধর্মের প্রবর্তক আর কবির ছিলেন ভক্তিবাদ আন্দোলনের প্রবক্তা।
ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উভয়েই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধাচরণ করেন। তারা জনসাধারণের মাঝে তাদের নিজস্ব বাণী প্রচার করে হিন্দু- মুসলিম সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কবিরের পরিচয় : চতুর্থ শতাব্দীতে রামানন্দ এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সর্বপ্রথম জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করেন। তার ১২ জন শিষ্যের মধ্যে কবির ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ।
Encyclopaedia of Religion and Ethies -632; V.7 বলা হয়েছে, "Kabir and Indian Teacher and religious reformar, flourished in North India about A.D. 1440 to 1518" জন্ম কবিরের জন্ম সাল নির্ণয় নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মকক্ষের দেখা যায়।
ম্যাক লিফ এর মতে, “কবির ১৩৯৮ সালে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।" Wertcatt বলেন, “কবির ১৪৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন।"
Kabir and The Kabir Panth (p:2-4) 4 G.H. westicott তার জন্ম সম্পর্কে তিনটি প্রচলিত বাক্য তুলে ধরেন।
১. কবির একজন ব্রাহ্মণ বিধবার পুত্র ছিলেন। ব্রাহ্মণ বিধবা লোক চক্ষুর আড়ালে তাকে বারানসীতে রেখে আসে। তখন মুসলিম নিরু ও নিমা নামের দম্পতি তাকে দেখতে পায়।
এই দম্পত্তির কোনো সন্তান ছিল না। কবিরকে পেয়ে এই দম্পতি অত্যধিক আনন্দিত হয়। পরে কবির এদের কাছেই বড় হতে থাকে ।
২. মতান্তরে জানা যায়, প্রচলিত কোনো নিয়মে তার জন্য হয়নি, বরং তার মায়ের হাতের তালুতে তার জন্ম হয় ।
৩ মতান্তরে জানা যায়, তিনি স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আসেন। Encyclopaedia of Religion and Ethics উল্লেখ আছে যে, "All stories agree tha the child wis brought up by a weaver named Niru and his wife Nima."
কর্মজীবন : কবিরের শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে তিনি হিন্দু দর্শন, সুফিদর্শন ও বাউল দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি রামানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি সাধারণ মানুষকে তাদের নিজস্ব ভাষায় বাণী দান করতেন এবং দোয়ার মাধ্যমে ভক্তের মূলকথা প্রচার করতেন। ধর্মের ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের চেষ্টাই তিনি প্রথম করেছিলেন।
মূর্তিপূজা ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ভক্তিবাদ নামক একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের কাজ করেছিলেন।
নানকের পরিচয় : নানক ছিলেন শিখ ধর্মের প্রবর্তক। তিনি গুরু নানক, বাবা নানক বা নানক শাহ নামেও পরিচিত। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে তার জন্ম উৎসব পালিত হয়।
তিনি বহু স্থানে ভ্রমণ করে মানুষের মধ্যে এক ঈশ্বরের মতবাদ প্রচলন করেন। শিখ ধর্মে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, পরবর্তী শিখ গুরুদের শুরু পদ লাভের সময় তাদের মধ্যে গুরু নানকের ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও পবিত্রতা প্রবাহিত হয়ে থাকে।
ঐশ্বরিক ক্ষমতা,প্রথম জীবন ও পরিবার : গুরু নানক ১৪৬৯ সালের ১৫ এপ্রিল লাহোরের নিকটে অবস্থিত রায় ভোয়কি তালবন্দী গ্রামে এক হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
বর্তমানে এই স্থানটি পাকিস্তানের নানকানা সাহিব নামে পরিচিত। তার বাবার নাম ছিল মেহতা কল্যাণ দাস বেদী এবং মাতার নাম ছিল জন্ম দেবী। বাল্যকালে নানক ফারসি শেখেন এবং কিছু দিন তাওয়ান্দি স্কুলে অধ্যয়ন করেন।
পরে স্কুল ছেড়ে তিনি মরুচারি হিন্দু-মুসলিম, সাধু-সন্ন্যাসী ও ফকিরদের সঙ্গে জীবনযাপন করেন। কিছুদিন তিনি জলস্কর জেলার সুলতানপুরে আফগান প্রধানের হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করেন।
সেখানে তার মর্যাদা নামক এক মুসলিম ভৃত্যের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়, যে ছিল একজন রবাববাদক। তারা দুজনে মিলে সঙতিগানের একটি সুসংহত রূপ দেন।
কথিত আছে, সুলতানপুরে নানক এক আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন, যার মাধ্যমে তিনি মানব সমাজে ঈশ্বরের বাণী প্রচারের আদেশ পান।
সে অনুযায়ী তিনি ঘোষণা করেন যে, হিন্দু- মুসলিম বলে কিছু নেই। নানক হিন্দু ও মুসলিম উভয়েরই পবিত্র স্থানসমূহ মক্কা, মদিনা, বাগদান, সিংহল, কামরূপ, কাশী, গয়া, কুরুক্ষেত্র, বৃন্দাবন দিল্লি ইত্যাদি ভ্রমণ করেন।
তিনি শিষ্য অঙ্গদকে তার উত্তরসূরি মনোনীত করেন। কর্তার পুরে ১৫৩৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সমকালীন হিন্দু-মুসলিম সমাজে কবির নানকের প্রভাব : কবির ও নানক সমকালীন হিন্দু ও মুসলিম সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল কি না তা সঠিকভাবে জানা যায় না।
অনেকে মনে করেন যে, তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম সমাজে কবির ও নানক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আবার এ কথার পক্ষে সঠিক কোনো যুক্তি পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, তখন হিন্দু মুলমান তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করতো।
কবির ও নানকের উপদেশবলি তখন সমাজে প্রভাব বিস্তার করে নি। কবির ও নানক যে মত প্রকাশ করেছেন তা মূলত এক ঈশ্বরের ধারণা নিয়েছেন এবং হিন্দু ও মুঘলমান সমন্বয়ের কথা বলেছেন।
কিন্তু পরবর্তী গুরু নানকের মত থেকে জন্মলাভ করে শিখ ধর্ম এবং কবিরের মতানুসারী নিজেকে কবিরপন্থি হিসেবে পরিচয় দিত।
কবির ও নানকের মতবাদ সে সময় প্রভাব বিস্তার না করলে পরবর্তীতে এটি বিশেষ করে মুঘল আমলে সম্রাট আকবরের সময় প্রভাব বিস্তার করেছিল।
বর্তমানে ভারতবর্ষে কবির ও নানকের মতাদর্শের অনেক লোক পাওয়া যায়। তাছাড়া ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও হিন্দু-মুসলিম মিলনে কবির ও নানকের মতবাদ এখনো প্রভাব বিস্তার করেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরু নানক ও কবির এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা মূলত হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সমঝোতা আনার চেষ্টা চালিয়েছেন।
তাদের অত্যধিক চেষ্টার ফলে ভারতে দুটি নতুন ধর্মমতের সৃষ্টি হয় এবং এই দুটি ধর্মমত সমকালীন সময়ে হিন্দু ও মুসলিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।