দ্বিতীয় মহীপালের সময় সংঘটিত দিব্যক বিদ্রোহ সম্পর্কে যা জান তা উল্লেখ কর
দ্বিতীয় মহীপালের সময় সংঘটিত দিব্যক বিদ্রোহ সম্পর্কে যা জান তা উল্লেখ কর |
দ্বিতীয় মহীপালের সময় সংঘটিত দিব্যক বিদ্রোহ সম্পর্কে যা জান তা উল্লেখ কর
- অথবা, দ্বিতীয় মহীপালের সময় সংঘটিত দিব্যক বিদ্রোহ সম্পর্কে ফলাফল উল্লেখ কর।
উত্তর : ভূমিকা : যুদ্ধবিগ্রহ ইতিহাসে এক নিত্য নৈমিত্তিক খেলা। যা প্রতিনিয়তই সংঘঠিত হয়েছে বিভিন্ন রাজার রাজত্বকালে।
তেমনি একটি বিদ্রোহ দিব্যক বিদ্রোহ যা সংঘটিত হয় দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করলে কর্ণ কালচুরি পাল সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন।
ইতিহাসে বৈধ নায়ক দিব্য এবং দ্বিতীয় মহীপালের মধ্যে সংঘটিত বিদ্রোহ দিব্যক বিদ্রোহ নামে খ্যাত। এ বিদ্রোহে দিব্যক কর্তৃক দ্বিতীয় মহীপাল পরাজিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন।
→ দ্বিতীয় মহীপালের পরিচয় এবং সিংহাসনে আরোহণ : দ্বিতীয় মহীপাল, দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপাল ছিলেন বিগ্রহ পালের তিন পুত্র। বিগ্রহ পালের মৃত্যুর পর তাঁর জৈষ্ঠ্যে পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭০-১০৭১) খ্রিষ্টাব্দে পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজত্বকালের প্রধান ঘটনা হলো উত্তর বাংলার সামন্ত বিদ্রোহ।
নিচে প্রশ্নালোকে দিব্যক বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
→ দিব্যক বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ : পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে অনেক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। এমনি একটি বিদ্রোহ হচ্ছে দিব্যক বিদ্রোহ। দিব্যক বিদ্রোহ ছিল পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার ভাঙনের একটি খেলা।
রামচরিত থেকে জানা যায়, “সম্মিলিত চক্র" বা "মিলিতাস্তক চক্র" দ্বারা দিব্যক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। মূলত দিব্যর একটি বৃহৎ উদ্দেশ্য ছিল।
তার মতে, মহীপাল জনসাধারণের উপর অন্যায় অত্যাচার তথা কুশাসন প্রয়োগ করছে। এর প্রতিকার করতে দিব্য বিদ্রোহের জন্য এগিয়ে আসেন।
তবে ড. আর. সি. মজুমদার একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার মতে, সোপাল যেমন জনসাধারণের ইচ্ছায় ক্ষমতা গ্রহণ করেন তদ্রুপ মহীপাল জনসাধারণের ইচ্ছায় সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আবার অনেক মনে করেন যে,দিব্যক বিদ্রোহ ছিল সামস্ত বিদ্রোহ। কারো কারো মতে, এ বিদ্রোহ সামন্ত বিদ্রোহ ছিল না।
রামপ্রসাদ, যদুনাথ সরকার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ চিন্তাযানের ধারণা, দ্বিতীয় মহাপালের কুশাসনের কবল থেকে জনসাধারণকে যুক্ত করতে দিবাকের আগমন ঘটে।
সন্ধ্যাকর নদীর মন্তব্যে ও দ্বিতীয় মহীপালের কুশাসনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কৈবর্ত সম্প্রদায় ও যুদ্ধের ঘোষণা করে। দিব্যক ছিলেন বারেন্দ্রীর অন্যতম সামন্ত ও দ্বিতীয় মহীপালের কর্মচারী।
তিনি বিদ্রোহের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন কি না এটা সঠিকভাবে বলা যায় না। দিব্য যদি অবৈধ কোনো কাজকর্মই করবেন তবে অপর সামন্তগণ এবং জনগণই বা কেন তাকে মেনে নিবে।
পাল সিংহাসনে অন্য লোককে জনসাধারণ মেনে নিবেন এটা চিন্তাও করা যায় না। দিবা একজন জনপ্রিয় লোক ছিলেন তিনি একটা ইতিবাচক বা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতেন।
তার বংশের তিন পুরুষ বারন্দ্রীয় রাজ সিংহাসন অলংকৃত করতো। রাজা ভীম ছিল খুবই জনপ্রিয়। যদি কৈবর্ত রাজারা জোর করে পাল সিংহাসন দখল করতো তবে রামপাল সিংহাসন লাভে সামন্তদের নিকট থেকে সাহায্য পেত না।
যদিও রামপাল বার বার সামন্ত সাহায্য লাভ করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে জনগণের সমর্থন লাভ করেন। ইত্যাদি থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, দিবা কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামস্ত বিদ্রোহী নয়।
সুতরাং একথা স্পষ্টভাবে আমরা বলতে পারি যে, দিব্যর বিদ্রোহের পশ্চাতে জন সমর্থন থাকতে পারে তবে কৈবর্ত বিদ্রোহে কোনো সামাজিক গুরুত্ব ছিল না।
কৈবর্ত বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ধর্মীয় কারণ কাজ করে থাকবে। কারণ অত্যাচারী বৌদ্ধ শাসক দ্বিতীয় মহীপাল কৈবর্তদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট কারণে আরও বেশি অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন।
দিব্যক সম্পর্কে সন্ধ্যাকর নন্দীর মন্তব্য: দিব্যক বিদ্রোহ সম্পর্কে সন্ধ্যাকর একটি অভিমত প্রকাশ করেছেন তা সত্য নয় মনে করা যায়। পালবংশের আশ্রিত এ লোকটি দিব্যকে 'দস্যু' ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি।
ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মিত্রের মতে, যদিও রামপাল ছিলেন দ্বিতীয় মহীপালের কনিষ্ঠ, তিনি ছিলেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তার স্থলে দ্বিতীয় মহীপাল ক্ষমতায় বসায়, সামন্ত শ্রেণি বিদ্রোহ করে।
কিন্তু রামপালই যদি সর্বসম্মত প্রার্থী হবেন তবে দ্বিতীয় মহীপালের পতনের পর সামন্ত শ্রেণি কেন তাকে সমর্থন জানাননি এবং কেন কৈবর্ত দিব্য বিনা প্রতিবাদে সিংহাসনে বসতে পারেনি। রামপালের স্বার্থে এ বিদ্রোহ হয় একথা বলা যায় না।
দিব্যক বিদ্রোহের ফলাফল : নিয়ে দিব্যক বিদ্রোহের ফলাফল উল্লেখপূর্বক আলোচনা করা হলো :
১. রাজ্যনৈতিক বিপ্লব সংঘঠিত : দিব্যক বিদ্রোহের ফলে এক বিরাট রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘঠিত হয়। পালবংশের রাজত্বকালে সিংহাসনে কৈবর্ত নায়ক দিব্যক এর বরেন্দ্র ভূমির সিংহাসনে আরোহণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিপ্লব সূচিত করে।
২. রাজ বংশের পরিবর্তন : দিব্যক বিদ্রোহের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো এ বিদ্রোহের ফলে বরেন্দ্র ভূমিতে রাজ বংশের পরিবর্তন সাধিত হয়। পালবংশের স্থলে আসে কৈবর্ত বংশের শাসন।
৩. দ্বিতীয় মহীপালের পতন : দিব্যক বিদ্রোহের অন্যতম এক ফল হলো অত্যাচারী পাল শাসক দ্বিতীয় মহীপালের পতন। দ্বিতীয় মহীপালের পতন হলে তদস্থলে ক্ষমতায় আসে কৈবর্ত রাজা দিব্যক।
৪. সামস্তদের ইচ্ছা পূরণ : দিব্যক বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি সামস্ত বিদ্রোহের প্রতিফল। দ্বিতীয় মহীপাল সিংহাসনে আরোহণ করে বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য সামন্তদের মন রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো দিব্যক বিদ্রোহ সংঘটিত হলে এতে দ্বিতীয় মহীপালের পতনের মধ্যে দিয়ে সামন্তদের ইচ্ছা পূরণ হয়।
৫. জনগণের মুক্তি লাভ : দিব্যক বিদ্রোহের অন্যতম একটি ফলাফল হলো জনগণের মুক্তিলাভ। দিব্যক বিদ্রোহের পূর্বে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ অত্যাচারী শাসক দ্বিতীয় মহীপালের কাজ কর্মের জন্য। এ বিদ্রোহের মাধ্যমে জনগণ মুক্তি লাভ করে অর্ত্যাচারের হাত থেকে।
৬. দিব্যকের মর্যাদা বৃদ্ধি : এ বিদ্রোহের ফলে কৈবর্ত নেতা দিব্যকের মর্যাদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তিনি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভসহ সামস্ত রাজদেরও মন জয় করে পাল শাসনের অবসান ঘটিয়ে বরেন্দ্র ভূমির সিংহাসনে আরোহণ করে।
মূলত অত্যাচারী শাসক দ্বিতীয় মহীপালের হাত থেকে জনগণ ও সামান্তদের রক্ষা করার কারণে তার মর্যাদা এত পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, কৈবর্ত নায়ক দিব্য কর্তৃক সংঘটিত বিদ্রোহ হচ্ছে দিব্যক বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের মাধ্যমে দিব্যক নানাভাবে জনসমর্থন লাভ করে পাল শাসন আমলে কৈবর্ত শাসন প্রতিষ্ঠা করে যে কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে তার পরবর্তী তিন পুরুষ।
কেননা তিনি মারা যাওয়ার পরও তার প্রতিষ্ঠিত কৈবর্ত বংশের শাসন বাংলায় বহুদিন পর্যন্ত টিকেছিল। দিব্যক বিদ্রোহ ছিল সামন্ত বিদ্রোহ যার নেতৃত্ব দিয়ে কৈবর্ত নেতা দিব্যক বরেন্দ্র ভূমিতে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসে চির অমর হয়ে আছেন।