ধর্মপালের সাথে ত্রিশক্তি সংঘর্ষের কারণ আলোচনা কর
ধর্মপালের সাথে ত্রিশক্তি সংঘর্ষের কারণ আলোচনা কর |
ধর্মপালের সাথে ত্রিশক্তি সংঘর্ষের কারণ আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : প্রায় চারশত বছর স্থায়ী পালবংশের সর্বনাম ধর্মপাল যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তার কিছু আগ থেকেই আর্যাবর্ত তথা উত্তর ভারত অনেকগুলো ছো ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল।
ফলে সদা অঞ্চলে রাজনৈতিক জন্ম অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। আর্যাবর্তের কেন্দ্রস্থল কনৌজে এসময় কোনো রাজশক্তি ছিল না।
এ রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য অষ্টম শতকের শেষের দিকে মালব ও রাজস্থানের অর্ডার প্রতীকার রাজবংশ বাংলার পালবংশ এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজ বংশ উত্তর ভারতে অধিকার বিস্তারের জন্য যে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ সূত্রপাত করে তাই ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ নামে পরিচিত।
ত্রিশক্তি সংঘর্ষের কারণ : ধর্মপাল ও ত্রিশক্তি সংঘর্ষের পিছনে কতিপয় কারণ বিদ্যমান।
১. রাজনৈতিক অস্থিরতা : উত্তর ভারত অনেকগুলো ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত থাকায় সমগ্র অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্ব বিরাজ করছিল।
এ অবস্থায় পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাজ বংশগুলো রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্য ত্রিপক্ষীয় বা ত্রিশক্তি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে
২. কনৌজের সিংহাসন শূন্যতা : কনৌজ ছিল আর্যাবর্তের কেন্দ্রস্থল। অষ্টম শতকের শেষের দিকে কনৌজের সিংহাসনে কোনো উত্তরাধিকার না থাকায় ত্রিশক্তি সংঘর্ষের সূচনা হয়।
৩. প্রতিহার বংশের শক্তি বৃদ্ধি : প্রতিহার বংশের শক্তি বৃদ্ধি ত্রি- শক্তি সংঘর্ষের জন্য অন্যতম একটি কারণ। অষ্টম শতকে কনৌে সিংহাসন শূন্য থাকায় রাজ্য বিস্তার ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মালব ও রাজস্থানের গুর্জর প্রতিহার বংশ এই ত্রিশক্তি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
৪. রাষ্ট্রকূট রাজবংশের ক্ষমতা বৃদ্ধি : ত্রি-শক্তি সংঘর্ষের আর ও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজবংশে ক্ষমতা বৃদ্ধি। উত্তর ভারতের কেন্দ্রস্থল কনৌজে কোনো শক্তিশালী শাসক বা শাসক শূন্যতা থাকায় এ ত্রিশক্তি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
৫. ধর্মপালের রাজ্য বিস্তার মনোভাব : সিংহাসনে আরোহণ করে ধর্মপালের রাজ্য বিস্তারের মনোভাব ত্রিশক্তি সংঘষের আরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত।
৬. যোগ্য শাসকের অভাব : অষ্টম শতকে কনৌজের সিংহাসন ছিল শাসক শূন্য। এ অবস্থায় কনৌজ অধিকার করার জন্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো কনৌজ অধিকারের চেষ্টায় ত্রিশক্তি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ইত্যাদি কারণে ত্রিশক্তি সংঘর্ষ শুরু হয়।
→ ত্রিশক্তি সংঘর্ষ : এমন একটি অবস্থার মধ্যে ধর্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন যখন উত্তর ভারতে কোনো শক্তিশালী রাজা ছিল না।
তাই উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে বাংলার পালবংশ দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকুট রাজ্যবংশ এবং মালব ও রাজস্থানের গুর্জর প্রতিহার রাজ বংশের মধ্যে একটি সংঘর্ষের সূচনা হয়, যা ইতিহাসে ত্রিপক্ষীয় বা ত্রিশক্তি সংঘর্ষ নামে পরিচিত। এ সংঘর্ষকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় যথা-
প্রথম পর্যায় : প্রথম পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয় পালবংশের রাজা ধর্মপাল ও প্রতিহার রাজা বৎসরাজার সাথে। ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে গভের দোয়াব পরস্পর মুখোমুখী হন এবং প্রচণ্ড যুদ্ধে বৎসরাজ কর্তৃক ধর্মপাল পরাজিত হন।
অমোঘ বর্ষের সঞ্জন তাম্রশাসন ও সুরটি ও বারদান থেকে জানা যায় রাষ্ট্রকূট রাজ বংশের রাজা ধ্রুবধারাবর্ষ এবং বৎসরাজ্যের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যেবর্তী স্থানে।
দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজা ধ্রুবধারাবর্ষ ধর্মপাল ও বৎসরাজ দুজনকেই পরাজিত করেন। উত্তর ভারতে জয় করার পর ইন্দ্রায়ুধকে গুপ্ত প্রতিনিধি বানিয়ে উত্তর ভারতের সিংহাসনে বসিয়ে ধ্রুবধারাবর্ষ দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান।
তিনি ফিরে যাওয়ার পর ধর্মপাল তার শক্তি বৃদ্ধি করে ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত করেন। এটা ধর্মপালের খালিমপুর তম্রশাসন থেকে জানা যায়।
সোড্ডল তাঁর উদয় সুন্দরী কথা গ্রন্থে ধর্মপালকে উত্তরাপথস্বামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বলেন, ধর্মপাল কনৌজ অধিকার করলে অন্যান্য রাজ্য তার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়।
দ্বিতীয় পর্যায় : দক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজ বংশের রাজা ধ্রুবধারাবর্ষ ফিরে যাওয়ার পর ধর্মপাল উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ৭৯০-৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে।
বৎসরাজের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নাগভট্ট সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং বিভিন্ন রাজাদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করেন।
বারদান ও গোয়ালির লিপি থেকে জানা যায় নাগভট্ট তার শক্তি বৃদ্ধি করে ধর্মপালের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন।
কিন্তু তিনি তার পিতার মতোই ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ পাননি কারণ রাষ্ট্রকূট রাজবংশের রাজা তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারত আক্রমণ করে নাগভট্টকে পরাজিত করে। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি খুব সম্ভবত ৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মপালকে সাহায্য করে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান।
তৃতীয় পর্যায় : উৎসের অভাবে আমরা তৃতীয় পর্যায় সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারি না। ঐতিহাসিকদের মতে, তৃতীয় গোবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে যাওয়ার পর ধর্মপাল উত্তর ভারত আক্রমণ করে বিনা বাঁধায় সবকিছু দখল করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে ত্রি-পক্ষীয় বা ত্রিশক্তি সংঘর্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সংঘটিত হওয়া পিছনে ছিল অনেকগুলো কারণ বিদ্যমান।
যদিও এ ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে ধর্মপাল পরাজিত হয়েছিল। পরবর্তীতে নিজের সামরিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং কূটকৌশল দ্বারা পালবংশকে সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করান ।