দেবরাজ বংশের রাজত্বকালের বিবরণ দাও
দেবরাজ বংশের রাজত্বকালের বিবরণ দাও |
দেবরাজ বংশের রাজত্বকালের বিবরণ দাও
- অথবা, পাল শাসন আমলে দেবরাজ বংশ সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর : ভূমিকা : সপ্তম শতকের মাঝামাঝি হতে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব-বাংলায় কয়েকটি ছোট ছোট রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়।
এদের মধ্যে দেববংশ, চন্দ্র বংশ, শূর বংশ, ধর্মরাজ বংশ উল্লেখযোগ্য এ রাজবংশের মধ্যে কোনো কোনো রাজবংশ শতাধীন ও শান্ত ছিল। এদের মধ্যে দেবরাজ বংশ শক্তিশালী রাজবংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ।
] দেবরাজ বংশের রাজ্যসীমা : দেবরাজবংশের রাজ্যসীমা সঠিকভাবে জানা যায় না প্রয়োজনীয় উৎসের অভাবে। তবে মনে করা হয় দেবপর্বত কুমিল্লার নিকটবর্তী ময়নামতি পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সম্ভবত এটাই দেবরাজ বংশের রাজধানী ছিল।
খুব সম্ভবত দেবপালের পরবর্তী দুর্বল পাল রাজাদের শাসন আমলে দেব বংশের রাজাগণ শক্তি সঞ্চয় করে পূর্ববঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।
[] ধর্মবিশ্বাস : পাল শাসন আমলে দেবরাজ বংশের শাসন একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। তবে পাল শাসকগণ অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধধর্মের। তাই প্রাপ্ত তাম্রশাসন ও মুদ্রালিপি বিচার করলে এ ধারণা হয় যে দেবরাজবংশের রাজারাও ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
দেবরাজ বংশের শাসনকাল : দেবরাজ বংশের শাসনকাল বিচার বিশ্লেষণ করার মতো যথেষ্ট উপকরণ না থাকলেও বেশ কয়েকজন শাসকের নাম জানা যা তা নিম্নরূপে আলোকপাত করা হলো :
১. বীরদেব, আনন্দদেব, ও ভবদেব : অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে তাম্রশাসনে দেব রাজবংশের কিছুটা সঞ্চান পাওয়া যায়। পূর্ববংশের কুমিল্লার ময়নামতিতে এ রকম দুটি তাম্রশাসনের পরিচয় পাওয়া যায়।
এর একটিতে দেববংশের রাজবীরদেব, তা পুত্র আনন্দ দেব ও দৌহিত্র ভবদেবের নাম উল্লেখ আছে। রাজা ভবদেব সিংহাসনের আরোহণ করে নিজেকে মহারাজাধি রাজ পরমেশ্বর উপাধি গ্রহণ করেন।
ভবদেব দেব পর্বত হতে এ তাম্রশাসনখানি প্রদান করেন। এ তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, আনন্দদেব ও বীরদেব পরম সৌগত, মহারাজাধিরাজ, পরমভধারক ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সঠিক এবং উপযুক্ত প্রমাণের বা উৎসের অভাবে দেবরাজদের রাজ্যসীমা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না।
তবে এত টুকু জানা যায় যে, খড়গ রাজবংশের বিলুপ্তির পরই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতটে দেব রাজবংশের রাজত্বকালের গোড়াপত্তন হয়।
উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে ভবদেব ও তার পূর্ব পুরুষদের বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায় না। পরবর্তী পাল রাজাদের দুর্বলতার জন্য এ দেবরাজ বংশ পূর্ববঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
২. শান্তিদেব : পাল শাসন আমলে আমরা আর একজন রাজার নাম উল্লেখ পাই যার নাম ছিল শান্তিদেব। বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ববাংলায় এ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
দেবরাজ বংশের সাথে এ শান্তিদেবের কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা প্রয়োজনীয় উৎসের অভাব থাকায় আমরা এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারি না।
বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসনে শান্তিদেব, ধনদেব ও ভবদেবের নাম উল্লেখ আছে। অনুমান করা হয় যে, এ তাম্রশাসনটি নবম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ করা হয়েছে।
তবে এ থেকে বুঝা যায় যে, এ রাজবংশ দেবরাজ বংশের পর হওয়াই স্বাভাবিক। এ রাজবংশের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা ছিলেন শান্তিদেব।
একটি তাম্রলিপি হতে জানা যায় যে, তিনি হরিকেলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শান্তিদের মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন।
শান্তিদেবের রাজ্যের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুর। এসব পক্ষে কোনো উৎস দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত না হওয়ায় শান্তিদেব রাজ্যর অবস্থান ও প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
বর্ধমানপুর বলতে যদি আধুনিক বর্ধমান নগরীকে বুঝায় তাহলে এটা মানতে হবে যে, হরিকেল রাজ্য দক্ষিণ বঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল।
বর্ধমান নগরী থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব এত পরিমাণ বেশি যে, এটা অবিশ্বাস যোগ্য যে, শান্তিদেবের রাজ্য এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এক শক্তিশালী রাজকন্যা বিন্দুরতি ছিল শান্তিদেবের স্ত্রী। শান্তিদেব সম্ভবত কোনো রাজবংশে জন্মগ্রহণ করে রাজ ক্ষমতা গ্রহণ করেনি।
বিন্দুরভিকে বিবাহ করার ফলে তার সৌভাগ্যর দরজা খুলে যায়। তার রাজত্বকাল এবং তার বংশধরদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায় না। এছাড়া তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মমতাবলম্বী।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে একথা বলা যায় যে, পাল শাসনামলে অনেক রাজবংশের উত্থান হয় এদের মধ্যে দেবরাজ বংশ ছিল অন্যতম।
এ দেবরাজ বংশের বেশ কয়েকজন রাজা পালাক্রমে রাজ্য শাসন করে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল বীরদেব, আনন্দদেব ও ভবদেব এবং বর্ধমানের শান্তিদেব।
তবে এ দেবরাজ বংশের কয়েকজন রাজার নাম জানা গেলেও এ রাজবংশের সীমানাও এর অবস্থান জানা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা এ সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে বর্তমানে চট্টগ্রাম ছিল দেবরাজ বংশের রাজ্য বিস্তৃত।