দেব বংশের উত্থান পতনের ইতিহাস আলোচনা কর
দেব বংশের উত্থান পতনের ইতিহাস আলোচনা কর |
দেব বংশের উত্থান পতনের ইতিহাস আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীনকাল মধ্যযুগ ও আধুনিক কালের সকল সময়ের শাসকদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। আর তাহলো তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার।
দেব রাজবংশেরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে উৎসের অপ্রতুলতার কারণে দেব রাজবংশের উত্থান সম্পর্কে খুব বেশি একটা জানা যায়নি।
দেব রাজবংশের যে চারজন শাসক শাসন করেছিল তারা প্রত্যেকেই পরম ভট্টরক, পরমেশ্বর মহারাজাধিরাজ ইত্যাদি উপাধি ধারণ করেছিল।
[] দেব রাজবংশের উত্থান : প্রাচীন বাংলায় অষ্টম শতাব্দীর মধ্য ভাগে উপর্যুপরি বৈদেশিক আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল। এ আক্রমণে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে।
খড়গ রাজবংশের শাসনের পর অষ্টম শতকের প্রথম ভাপে দেব রাজবংশের উদ্ভব হয়। তাদের শাসন ছিল নবম শতাব্দীর হরিকেল রাজাদের পূর্ববর্তী কাল পর্যন্ত।
তাই ভদ্রশাসন ও উৎকীর্ণ লিপি বিচারে বলা যায় যে, দেব রাজারা অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সমতট অঞ্চল শাসন করতেন।
তারা আনুমানিক ৭৫০-৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। দেব রাজবংশ চারজন শাসক শাসন করেছিল। তারা হলেন শ্রী শান্তিদেব, শ্রী বীরদের, শ্রী আনন্দদেব, শ্রী ভবদেব।
১. ধীরদের, আনন্দদেব, ও ভবদেব : অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে তাম্রশাসনে দেব রাজবংশের কিছুটা সন্ধান পাওয়া যায়। পূর্ববংশের কুমিল্লার ময়নামতিতে এ রকম দুটি তাম্রশাসনের পরিচয় পাওয়া যায়।
এর একটিতে দেববংশের রাজবীরদের, তার পুত্র আনন্দ দেব ও দৌহিত্র বসেনের নাম উল্লেখ আছে। রাজা ভবদেব সিংহাসনের আরোহণ করে নিজেকে মহারাজাধি রাজ পরমেশ্বর উপাধি গ্রহণ করেন।
ভবদেব দেব পর্বত হতে এ তাম্রশাসনখানি প্রদান করেন। এ ভদ্রশাসন হতে জানা যায় যে, আনন্দদের ও বীরদের পরম সৌগত, মহারাজাধিরাজ, পরমভধারক ইত্যাসি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সঠিক এবং উপযুক্ত প্রমাণের বা উৎসের অভাবে দেবরাজদের রাজ্যসীমা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না।
তবে এত টুকু জানা যায় যে, খড়গ রাজবংশের বিলুপ্তির পরই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতটে দেব রাজবংশের রাজত্বকালের গোড়াপত্তন হয়।
উপর্যুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে ভবদেব ও তার পূর্ব পুরুষদের বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায় না। পরবর্তী পাল রাজাদের দুর্বলতার জন্য এ দেবরাজ বংশ পূর্ববঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
২. শান্তিদেব : পাল শাসন আমলে আমরা আর একজন রাজার নাম উল্লেখ পাই যার নাম ছিল শান্তিদেব। বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ববাংলায় এ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
দেবরাজ বংশের সাথে এ শান্তিদেবের কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা প্রয়োজনীয় উৎসের অভাব থাকায় আমরা এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারি না।
বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসনে শান্তিদেব, ধনদেব ও ভবদেবের নাম উল্লেখ আছে। অনুমান করা হয় যে, এ তাম্রশাসনটি নবম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ করা হয়েছে।
তবে এ থেকে বুঝা যায় যে, এ রাজবংশ দেবরাজ বংশের পর হওয়াই স্বাভাবিক। এ রাজবংশের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা ছিলেন শান্তিদেব।
একটি তাম্রলিপি হতে জানা যায় যে, তিনি হরিকেলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শান্তিদেব মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন।
শান্তিদেবের রাজ্যের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুর। এসব পক্ষে কোনো উৎস দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত না হওয়ায় শান্তিদের রাজ্যর অবস্থান ও প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
বর্ধমানপুর বলতে যদি আধুনিক বর্ধমান নগরীকে বুঝায় তাহলে এটা মানতে হবে যে, হরিকেল রাজ্য দক্ষিণ বঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল।
বর্ধমান নগরী থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব এত পরিমাণ বেশি যে, এটা অবিশ্বাস যোগ্য যে, শান্তিদেবের রাজ্য এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । এক শক্তিশালী রাজকন্যা বিন্দুরতি ছিল শান্তি দেবের স্ত্রী।
শান্তিদেব সম্ভবত কোনো রাজবংশে জন্মগ্রহণ করে রাজ ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। বিন্দুরতিকে বিবাহ করার ফলে তার সৌভাগ্যর দরজা খুলে যায়।
তার রাজত্বকাল এবং তার বংশধরদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায় না। এছাড়া তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মমতাবলম্বী।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে একথা বলা যায় যে, পাল শাসনামলে অনেক রাজবংশের উত্থান হয় এদের মধ্যে দেবরাজ বংশ ছিল অন্যতম।
এ দেবরাজ বংশের বেশ কয়েকজন রাজা পালাক্রমে রাজ্য শাসন করে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল বীরদের, আনন্দদেব ও ভবদেব এবং বর্ধমানের শান্তিদেব।
তবে এ দেবরাজ বংশের কয়েকজন রাজার নাম জানা গেলেও এ রাজবংশের সীমানাও এর অবস্থান জানা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা এ সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে বর্তমানে চট্টগ্রাম ছিল দেবরাজ বংশের রাজ্য বিস্তৃত ।