বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর
বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর |
বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর
- অথবা, বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের কারণ ও ফলাফল মূলায়ন কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বখতিয়ার খলজি এর বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। তের শতকে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে তিনি প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
বখতিয়ার খলজি (১২০৩ - ১২৩৪) খ্রিষ্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন এর পিছনে অনেক কারণ ছিল বিদ্যমান এবং এর ফলাফল ছিল মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী।
যার ফলে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরব্যাপী। নিম্নে প্রশ্নালোকে বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করা হলো :
→ বখতিয়ার খলজির পরিচয় : বখতিয়ার খলজি সম্পর্কে উৎসের অভাবে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে তিনি ছিলেন জাতিতে তুর্কি এবং বংশে খলজি। তিনি উত্তর আফগানস্তানের গরমণীরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিশাল দেহের অধিকারী। তিনি দেখতে ও সুদর্শন ছিলেন।
বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের কারণ : বখতিয়ার হলজির বঙ্গ বিজয়ের পিছনে কতিপয় কারণ বর্তমান ছিল। নিম্নে উল্লেখপূর্বক আলোচনা করা হলো ।
১. বাংলার মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে- বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্যই বখতিয়ার খলজি দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিনের অনুমিত নিয়ে বঙ্গ অভিযান করেন।
২. লক্ষ্মণ সেনের দুর্বলতা : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তৎকালীন বাংলার সেন শাসক লক্ষ্মণ সেনের দুর্বলতা যা বখতিয়ার খলজিকে অনুপ্রাণিত করেছিল বঙ্গ অভিযানে।
৩. অরক্ষিত : নদীয়া ছিল লক্ষ্মণ সেনের উপরাজধানী। তাই সামরিক ক্ষেত্রে নদীয়া ছিল অরক্ষিত এবং লক্ষ্মণ সেনের অমাত্যবর্গ এবং মন্ত্রীগণ আগে থেকে জানতে পেরেছিলেন যে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক নদীয়া আক্রমণ হতে পারে তাই তারা নদীয়া ছেড়ে পলায়ন করে।
৪. লক্ষ্মণ সেনের বার্ধক্য : লক্ষ্মণ সেন পরিণত বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথম দিকে দাপটের সাথে রাজ্য পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে তিনি তার এ দাপটতা পরিহার করেন এবং ধর্মকর্মে মনোযোগী হন। ফলে বখতিয়ার খলজি বঙ্গ অভিযানে আগ্রহী হন।
৫. তুর্কি সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব : লক্ষ্মণ সেনের সেনাবাহিনী অপেক্ষা তুর্কি সেনাবাহিনী দ্রুতগামী, সুকৌশলী ও বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ছিল। তাদের অতর্কিত আক্রমণ প্রफিরোধ করার মতো ক্ষমতা লক্ষণ সেনের সৈন্যদের ছিল না।
৬. জনগণের অসন্তোষ : লক্ষ্মণ সেনের অত্যাচারী শাসনের ফলে প্রজাগণ তার প্রতি অসন্তোষ ছিল। ফলে তারা রাজার রাজ শাসন থেকে মুক্তির জন্য লক্ষ্মণ সেনকে কোনো সাহায্য করেনি। এ দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে বখতিয়ার খলজি বঙ্গ আক্রমণ করেন।
৭. বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের আরও একটি অন্যতম কারণ হলো বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা। তাই বখতিয়ার খলজি বাংলার হিন্দু শাসক লক্ষণ সেনের বিরুদ্ধে অভিযান করে বঙ্গ বিজয় করে নেন।
৮. পরিচিত পথ পরিহার : বখতিয়ার বিলজির বঙ্গ বিজয়ের আরও একটি অন্যতম কারণ হলো তিনি পরিচিত পথ পরিহার করে দুর্গম পথে বঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন।
৯. বণিকের ছদ্মবেশ ধারণ : বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয়ের অন্যতম একটি কারণ হলো বণিকের ছদ্মবেশ ধারণ। বণিক সেজে তিনি লক্ষ্মণ সেনের প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অতর্কিতে হামলা চালান।
১০. মূল সৈন্যবাহিনীর তড়িৎ আক্রমণ : মাত্র ১৮ জন সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খলজি লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং এর অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর মূল বাহিনী এসে উপস্থিত হয়। এ অবস্থায় লক্ষ্মণ সেন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পেরে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান।
বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের ফলাফল : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের ফলে বাংলা হতে চিরতরে হিন্দু শাসনের অবসান ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম শাসন।
নিম্নে প্রশ্নালোকে বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের ফলাফল উল্লেখপূর্বক আলোচনা করা হলো :
১. মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ অভিযানের মধ্যে দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এজন্যই বখতিয়ার খলজিকে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার স্রষ্টা বলা হয়। তাঁর বঙ্গ অভিযানের মাধ্যমে বাংলা হতে চিরদিনের মতো হিন্দু শাসনে অবসান হয়।
২. হিন্দু শাসনের অবসান : বনতিয়ার খলজির বঙ্গ অভিযানের ফ৭ বাংলা থেকে হিন্দু শাসনের অবসান ঘটে এবং তদস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম শাসন। বাংলা হতে সেন রাজবংশের শাসনেরও সমাপ্তি ঘটে।
৩. মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূচনা : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পথের সূচনা হয়। এ অঞ্চলের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে প্রায় ৫৫০ বছর বাংলায় মুসলিম শাসন স্থায়ী হয় ।
৪. ইসলামের প্রচার বৃদ্ধি : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের ফলে উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
যদিও মুসলিমদের বঙ্গ বিজয়ের পূর্বে বাংলায় বহু সার্বিক ও সুফী বাংলায় ধর্ম প্রচার করতে এসেছিল। এসব সুফী সাধকদের প্রচার আরও বৃদ্ধি পায় বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমেই।
৫. ধন-সম্পদ লাভ : বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করে লক্ষ্মণ সেনের অনেক ধন সম্পদ লাভ করেন। এছাড়াও ভূতবর্গ এবং বিপুল সংখ্যক হস্তি তিনি লাভ করেন।
৬. রাজ্য সীমা নির্ধারণ : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের ফলে উত্তরে তার রাজ্য সীমা পূর্ণিয়া দেবকোট ও রংপুরের পূর্বে ভিস্তা ও করতোয়া নদীর এবং পশ্চিমে কুশী নদীর নিম্নাংশ থেকে রাজমহলো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।
৭. আদর্শিক ফলাফল : বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের ফলে বাংলায় বিভিন্ন দেশের অধিবাসীরা এসে বসতি স্থাপন করে এদের মধ্যে, আফগান, তুর্কি আরববাসী প্রভৃতি বসতি স্থাপন করে।
এ সময় ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি পায়। বহু আলেম অবাধে ইসলাম ধর্ম প্রচার করে। বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পিছনে অনেকগুলো যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল। ফলে বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয়ে আগ্রহী হয়ে বঙ্গ বিজয় করেন।
এ বিজয়ের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয় ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয়ের তাঁর জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে বাংলায় 'মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ।