বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেন রাজাদের অবদান পর্যালোচনা কর
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেন রাজাদের অবদান পর্যালোচনা কর |
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেন রাজাদের অবদান পর্যালোচনা কর
- অথবা, বাংলায় সেন রাজাদের কৃতিত্ব বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : পাল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে ওঠা সেন রাজাদের শাসনকাল প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
বাংলায় সেন শাসন প্রায় (১০৯৫-১২০৬) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একশত বছর স্থায়ী ছিল। এ সময় পর্যায়ক্রমে অনেক সেন শাসক বাংলায় শাসন পরিচালনা করে।
তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। যেমন- শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সেন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল অপরিসীম।
• বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেন রাজাদের অবদান : বাংলায় সেন শাসন এক দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সময় সেন শাসকগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হন।
নিম্নে বাংলায় সেন রাজাদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. বাংলার গৌরব বৃদ্ধি : পাল শাসনের অবসানের পর | বিজয় সেন বাংলায় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রায় ৬৩ বছর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। মূলত তাঁর শাসন আমলে বাংলায় সেন সাম্রাজ্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী সেন শাসক বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালেও বাংলার গৌরব অক্ষুণ্ণ ছিল বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত। ভাই বলা যায় সেন আমলেই বাংলার গৌরব ও মর্যাদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
২. শিক্ষা ও আমের বিকাশ : প্রত্যেক সেন শাসকই জনী ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়।
বেদ, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, ব্যাকরণ প্রভৃতি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিশেষ উন্নতি ঘটে সেন শাসন আমলে।
৩. সংস্কৃতি সাহিত্যের বিকাশ : সংস্কৃতি সাহিত্যের বিকাশ লাভ শুরু হয় পাল আমল থেকে কিন্তু সেন আমলে এসে এ সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সংস্কৃত ভাষায় বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়।
৪. ধর্মাশ্রয়ী গ্রন্থ রচনা : শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন প্রত্যেক সেন শাসক। তাদের মধ্যে অনেকেই কাব্য রচনা করে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
এক্ষেত্রে বল্লাল সেনের 'দানসাগর', 'অদ্ভুতসাগর' গ্রন্থের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া লক্ষ্মণ সেনের পৃষ্ঠপোষকতায় পণ্ডিত হলায়ুধ, ব্রাহ্মণ সর্বস্ব' 'বৈষ্ণব সর্বস্ব', মীমাংসা সর্বস্ব প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।
৫. কাব্যগ্রন্থের বিকাশ : প্রাচীন বাংলায় সেন শাসনামলে সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থের অপূর্ব বিকাশ ঘটে। সেন যুগের কবিদের রচিত কাব্যগ্রন্থ সংস্কৃত সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
লক্ষ্মণ সেনের শাসন আমলে কবি, ধোয়ী রচিত 'পবনদূত' জয়দেব রচিত 'গীতগোবিন্দ', গোবর্ধন রচিত, 'আর্যসন্তদর্শী' প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থকে সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
৬. ভাষাতত্ত্বের বিকাশ : সংস্কৃত ভাষাতত্ত্বের বিকাশ ঘটে সেন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়। কবি সর্বানন্দ রচিত “টীকা সর্বস্ব' ভাষাতত্ত্বের বিকাশে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল।
তাছাড়া সেন শাসন আমলে ভাষাতত্ত্বের বিকাশে আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয় এর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে— 'ভাষাবৃত্তি' : 'হারাবলী' বর্ণদেখানো প্রভৃতি ।
৭. ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা : বাংলায় সেন শাসনামলে সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশে আরও একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে ব্যাকরণ শাস্ত্র অধিকার বা ব্যাকরণের ব্যবহার সংস্কৃত সাহিত্যকে এক অনন্য মাত্রা এনে দেয়।
৮. সমাজ সংস্কার : বাংলায় সেন শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে সেন শাসকগণ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার করতে আগ্রহী হয়ে সমাজ সংস্কার করেছেন।
বল্লাল সেন তার রাজত্বকালে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন করে সেন যুগের বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন।
৯. হিন্দুধর্মের প্রসার : বাংলায় সেন শাসন আমলে হিন্দুধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে। কেননা প্রত্যেক সেন শাসকই ছিল ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের অনুসারী। হিন্দু ধর্ম ছাড়াও সেন যুগে বৈদিক, শৈব ও বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক প্রচলন ঘটে ছিল।
১০. শিল্পকলার বিকাশ : শিল্পকলার বিকাশ সাধনে সেন রাজাগণ পাল রাজাদের মতোই পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন। সেন যুগে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় এদের মধ্যে বরেন্দ্রভূমির শিল্প গোষ্ঠীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ সময়কার কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পী হলেন- মূল পণি, বিষ্ণুভদ্র, কর্মভদ্র মহীধর, শশীদেব। বিমলদাস প্রমুখ। স্থাপত্য, ভাস্কর্যে এবং চিত্রাঙ্গনে তাদের অসাধাণ শিল্প বিজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।
তারা ধাতু, পাথর ও কাঠের উপর খোদাই করে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করতো। এসব খোদাই করা মূর্তি এবং বিভিন্ন মন্দির থেকে সেন যুগের শিল্পকলার পরিচয় লাভ করা যায় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলায় সেন শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে সেন রাজাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য।
তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে সেন শাসনের উন্নতি ঘটিয়েছেন।
সুতরাং একথা বলা ঠিকই হয় যে, সেন রাজাদের অসামান্য অবদান প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।