বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠায় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এর অবদান মূল্যায়ন কর
বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠায় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এর অবদান মূল্যায়ন কর |
বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠায় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এর অবদান মূল্যায়ন কর
- অথবা, বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠায় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এর কৃতিত্ব আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলায় ইতিহাসে এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনিই প্রথম শাসক যিনি বাংলার ইতিহাসে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পূর্ব বাংলায় রাজত্ব করেন।
তিনি সর্বপ্রথম বাংলায় স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করেন এবং তা প্রায় ২০০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মাত্র দু'দশকের রাজনীতিতে তিনি অসাধারণ মেধা ও দেশপ্রেম দিয়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষে এক বিরল ইতিহাস রচনা করেন। তিনি ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর বাংলা শাসন করেন।
→ ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসন : নিম্নে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসন আলোচনা করা হলো :
১. ক্ষমতাগ্রহণের প্রেক্ষাপট : বাংলা ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে দিল্লির সাম্রাজ্যভুক্ত প্রদেশ ছিল। দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ-বিন-তুঘলক সেই সময়ে তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ দমনে ব্যতিব্যস্ত থাকায় সুদূর বাংলার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারেননি।
তাই ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তীকালে বাংলার ঘটনাপ্রবাহ স্বাধীনতাকে অব্যাহত রাখে এবং ধীরে ধীরে সোনারগাঁও ছাড়া অন্যান্য কেন্দ্রেও স্বাধীনতার সূচনা করে।
১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বাহরাম খান মৃত্যুবরণ করলে দিল্লি থেকে সোনারগাঁও এ নতুন শাসনকর্তা প্রেরণে বিলম্ব হয়। এ বিলম্বের সুযোগ গ্রহণ করেন ফখরুদ্দিন এবং সুলতান হিসেবে পূর্ব বাংলার স্বাধীন নরপতিরূপে সিংহাসনে উপবিষ্ট হন।
২. কদর খান ও অন্যান্যদের সংঘর্ষ : ফখরুদ্দিনের স্বাধীনতার খবর পেয়ে লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান, লখনৌতির মুস্তৌফি হুসাম উদ্দিন আবু রাজা, সাতগাঁও -এর শাসনকর্তা আজম-উল- মুলুক এবং কারার শাসনকর্তা ফিরোজ খান সোনারগাঁও আক্রমণ করেন।
ফখরুদ্দিনও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন; তিনি তাদেরকে বাধা দিলেন কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।কনর খান এবং অন্যরা ফখরুদ্দিনের হাতি, ঘোড়া, ধনসম্পদ দখল করেন।
যুদ্ধের পর কলর খান সোনারগাঁও এ থেকে যান। অন্যরা ফিরে গিয়েছিল কিনা সঠিক জানা যায় না। তবে পরবর্তীকালে কেবল কনর খান ও ফখরুদ্দিনের মধ্যে সংঘর্ষের উল্লেখ পাওয়া যায়।
৩. কনর খানের পতন : ফখরুদ্দিন সোনারগাঁও থেকে পালিয়ে৷ নদী পার হয়ে নদীর পূর্ব তীরে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।
বর্ষাকালে তিনি পাল্টা আক্রমণ করেন। কদর খান যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পত্তি সৈন্যদলের মধ্যে ভাগ না করায় তাঁর সৈন্যদলে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল।
এই অসন্তোষের সুযোগে ফখরুদ্দিন তাঁর সৈন্যদলে বিভেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। ফলে অনেক সৈন্য কদর খানের পক্ষ ত্যাগ করে ফখরুদ্দিনের সৈন্যদলে যোগদান করে।
যুদ্ধে কদর খান পরাজিত ও নিহত হন। ফৎরুদ্দিন সোনারগাঁও পুনরুদ্ধার করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন
৪. লখনৌতিতে অভিযান : সোনারগাঁও এ কনর খানের মৃত্যুর পর লখনৌতিতে তাঁর সৈন্যাধ্যক্ষ (আরিফ) আলী মুবারক সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
ফখরুদ্দিন লখনৌতি অধিকার করার উদ্দেশ্যে মুখলিস নামক তাঁর এক সেনাপতিকে লখনৌতি আক্রমণ করতে পাঠান।
কিন্তু আলী মোবারক তাঁকে পরাজিত করেন। অতঃপর প্রায় প্রতি বৎসরই লখনৌতি ও সোনারগাঁও -এর মধ্যে যুদ্ধ লেগেই ছিল।
৫. চট্টগ্রাম বিজয় : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাঁর রাজ্যসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বর্ধিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সময়েই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম অঞ্চল মুঘলমানদের শাসনাধীনে আসে।
সপ্তদশ শতকের কবি মোহাম্মদ খানের বংশ পরিচয়ে এই বিষয়ের পরোক্ষ উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহাসিক শিহাবউদ্দিন তালিমের ইতিহাসেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে।
তালিশ আরও উল্লেখ করেছেন যে, ফখরুদ্দিন চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ তৈরি করেছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রামে তাঁর কতিপয় স্থাপত্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
তাই বলা যায়, চট্টগ্রাম বিজয় ফখরুদ্দিনের রাজত্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই বিজয় সম্পন্ন হয়।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের কৃতিত্ব : তৎরুদ্দিন মুবারক শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। তাঁর রাজ্যজয় প্রমাণ করে যে, তিনি বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসক ছিলেন।
জনদরদি শাসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল যা বাংলার স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হচ্ছে-
১. স্থাপত্যকর্ম : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ স্থাপত্যকর্মে কৃতিত্ব রাখেন। তিনি বহু মসজিদ ও অট্টালিকা নির্মাণ করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামে বহু ইমারত, সমাধি, ভবন, মসজিদ, রাস্তাঘাট নির্মাণ করে শহরকে শোভিত করেন। এছাড়া দিঘি খনন করেন।
২. জ্ঞানীগুণীদের কদর : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ জ্ঞানী- গুণীদের যথেষ্ট কদর করতেন। তার শাসনামলে ইসলাম প্রচারের পথ প্রেশন হয়। তাঁর উদার পৃষ্ঠপোষকতায় ফকির-দরবেশগণ নির্বিঘ্নে ইসলাম প্রচারে উৎসাহী হয়।
৩. সোনারগাওয়ের উন্নতি : তাঁর সময়ে সোনারগাঁও -এর যথেষ্ট উন্নয়ন সাধন হয়। তিনি সোনারগাঁওয়ে বহু ইমারত, মসজিদ, রাস্তাঘাট নির্মাণের মাধ্যমে রাজধানীর ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন এবং শ্রী বৃদ্ধি করেন।
৪. ইবনে বতুতার বর্ণনা : মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে ১৩৪৫-৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় আসেন। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে তৎকালীন বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায়।
তিনি বাংলার খাদ্যশস্যের প্রাচুর্যতা ও জিনিসপত্রের দামের স্বল্পতার প্রশংসা করেন। এছাড়া তিনি বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও প্রশংসা করেন।
৫. আধ্যাত্মিক লোকদের প্রতি ভক্তি : ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে আরো জানা যায় যে, ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ফকির- দরবেশদের প্রতি উদার ছিলেন।
কোন ফকির-দরবেশ তাঁর রাজধানীতে প্রবেশ করলে তাদের অর্ধ-দিনার (প্রায় আট আনার মতো) উপঢৌকন দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হতো।
নৌকায় যাতায়াত করলে ফকিরদের পয়সা দিতে হতো না। তবে অমুঘলমানরা জিম্মীরূপে পরিগণিত হতো এবং তাদের উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক রাজস্বসহ অন্যান্য কর দিতে হতো।
মৃত্যু : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মৃত্যু সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ, দেখা যায়। তবে তাঁর প্রাপ্ত মুদ্রার সাক্ষ্য এই যে, তিনি ৭৫০ হিজরি/১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ে রাজত্ব করে মৃত্যুবরণ করেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ সোনারগাঁও -এর সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফখরুদ্দিনের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৩৩৮ খ্রি. ফখরুদ্দিন কর্তৃক সোনারগাঁও –এর ক্ষমতা অধিকার বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনের সূচনা করে।
চট্টগ্রাম জয় তাঁর শাসনামলের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার হাত ধরে বাংলায় যে স্বাধীনতার সূচনা হয়েছিল তার স্থায়ীত্ব হয়েছিল ২০০ বছরব্যাপী।
তুঘলক বংশের পর দিল্লির সুলতানদের দুর্বলতা এবং বাংলার সুলতানদের সুপ্রতিষ্ঠিত শাসন এই স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠায় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের অবদান অপরিসীম ।