বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকাল বর্ণনা কর
বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকাল বর্ণনা কর |
বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকাল বর্ণনা কর
- অথবা, বাংলায় ইলিয়াসশাহী বংশের রাজত্বকাল সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর : ভূমিকা : ইলিয়াসশাহী বংশের শাসন বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ইলিয়াস শাহী পূর্ব যুগে বাংলার মুসলিম রাজা লখনৌতি রাজ্য নামে অভিহিত ছিল।
কিন্তু ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ রাজ্য বাংলার মুসলিম রাজ্যরূপে পরিচিত লাভ করে। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম বাংলাকে একত্রিত করে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
এ বংশের মোট ১১ জন সুলতান সাময়িক বিরতিসহ ১৩৪২-১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। এ বংশের শাসনামলে বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।
ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠা : সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের আমলে সর্বপ্রথম তুখরিল খান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু সুলতান তাকে কঠোরহস্তে সমন করেন।
অতঃপর গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সুলতান তাকে অধীনস্থ করে সোনারগাওয়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
তিনি পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তার অনুচর বাহরাম খান তাকে হত্যা করে সোনারগাঁওয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন।
বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তার বর্মরক্ষক ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাওয়ে স্বীয় ক্ষমতা সুদৃঢ় করেন। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন আলী শাহ উত্তরবঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।
অতঃপর তার পালিত ভ্রাতা হাজী ইলিয়াস ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতা দখল করে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।
এভাবে ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসে এ বংশের শাসনকাল স্বাধীন সত্তা ও ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটায়।
→ বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকাল : বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের শাসনকার্য সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮ খ্রি.) : হাজী ইলিয়াস শাহ পূর্ব ইরানের সিজিস্তানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহের ধাত্রী ভ্রাতা ছিলেন।
প্রাথমিক জীবনে তিনি দিল্লির মালিক ফিরোজের (পরবর্তীকালে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক) অধীনে চাকরি করতেন।
পরে সাতগাঁও এর তুঘলক শাসনকর্তার অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন এবং সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তার মৃত্যুর পর ইলিয়াস শাহ ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সাতগাঁয়ের অধীশ্বর হন।
অতঃপর তিনি রাজ্যবিস্তার করে অতিসহজেই সোনারগাঁও ও লখনৌতি দখল করেন। এভাবে তিনি পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গকে যুক্ত করে অথত বঙ্গদেশের একাচ্ছর সুলতানের মর্যাদা লাভ করেন। রাজ্য জয় এবং ইসলাম প্রচারে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
২. সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯০/৯১খ্রি.) : সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি প্রায় ৩৪ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর এ সুদীর্ঘ রাজত্বকালে বাংলার মুসলিম শাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তিনি ছিলেন সুশাসক ও প্রজাবৎসল। তার সময়ে বাংলার মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। স্থাপত্যশিল্পে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম।
৩. গিয়াসুদ্দিন আযম শাহ (১৩৯০/৯১-১৪১০/১১ খ্রি.) : সিকান্দর শাহের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র গিয়াসুদ্দিন আযম শাহ ১৩৯০/৯১ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। তিনি একজন দক্ষ শাসক ও প্রজাবৎসল নৃপত্তি ছিলেন।
সাম্রাজ্য বিস্তার অপেক্ষা নিজ রাজ্যে শাস্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। গিয়াসুদ্দিন আযম শাহ ন্যায়বিচারক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
তিনি বিদ্যোৎসাহী ও ধর্মভীরু ছিলেন এবং মক্কা ও মদিনায় বহু অর্থ ব্যয়ে মক্তব-মাদ্রাসা ও সরাইখানা নির্মাণ এবং খাল খনন করেন। তিনি বাংলায়ও শিক্ষা বিস্তারে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন।
বিভিন্ন দেশের সাথে গিয়াসুদ্দিন আযম শাহের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ১৪১০/১১ খ্রিষ্টাব্দে আযম শাহের মৃত্যু হয় এবং সোনারগাওয়ে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
৪. সাইফউদ্দিন হামযা শাহ : পিয়াসুদ্দিন আযম শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র সাইফউদ্দিন হামযা শাহ সিংহাসনে বসেন। ফিরোজাবাদ, সাতগাঁও এবং মুয়াজ্জামাবাদ টাকশাল থেকে প্রকাশিত মুদ্রা সাক্ষ্যে দেখা যায় যে, তিনি ১৪১০/১১ খ্রি. থেকে ১৪১১/১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন।
তার সময়ে চীন সম্রাটের দূত বাংলায় আসেন। ঐতিহাসিক ফিরিশতার মতে, সাইফউদ্দিন হামজা শাহ সাহসী, উদার ও ধৈর্যশীল নরপতি ছিলেন।
তার বৃদ্ধি ও ব্যবহারিক জ্ঞান থাকায় কর্মচারীরা সাবধানে রাজকার্য পরিচালনা করতো। কিন্তু হামজা শাহ বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেননি।
কারণ রাজা গণেশের চক্রান্তে সুলতানের ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিন তাকে হত্যা করেন এবং নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
৫. শিহাবউদ্দিন বায়োজিন শাহ : শিহাবউদ্দিন বায়োজিল শাহের প্রকৃত পরিচয় অনেকদিন পর্যন্ত অজানা থাকলেও বর্তমানে এ বিষয়ে যথেষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে।
রোজ শাহ কর্তৃক প্রকাশিত মুদ্রা নিজেকে তিনি শাহের পুত্র হিসেবে দাবি করেননি। ইবনে হুজর তার ইনবা উল-গমর" গ্রন্থে বলেছেন, শিহাব উদ্দিন বায়োজিদ শাহ শাহের ক্রীতদাস ছিলেন এবং তিনি গণেশের বিশ্বাসঘাতকতা করে তার প্রভুকে হত্যা করে নিজে সিংহাসন দখল করেন।
সম্ভবত রাজা হওয়ার পরে বায়োজিন গণেশের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সময় কাভের চেষ্টা গণেশ তাকে হত্যা করেন।
৬. আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ : কোনো ইতিহাস এ বায়োজিদ শাহের পরবর্তী সুলতানের নাম পাওয়া যায় না। কিন্তু বায়োজিন শাহের শেষ বছরে অর্থাৎ ১৪১৪/১৫ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ কর্তৃক উৎকীর্ণ মুদ্রা পাওয়া যায় এবং মুদ্রায় তিনি নিজেকে বায়োজিদ শাহের পুত্ররূপে দাবি করেন।
আধুনিক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, শিহাবউদ্দিনকে বধ করার পর গণেশ আলাউদ্দিনকে নামমাত্র রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নিজেই আগের মতো রাজ্য শাসন করতে থাকেন, এবং কয়েকমাস পর যখন বুঝতে পারেন যে, কাউকে শিখন্তি রাজা না রাখলেও চলবে তখন তিনি আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করেন। এভাবে রাজা গনেশের চক্রান্তে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন হয়।
৭. নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ : রাজা গণেশের বংশের পতনের পর শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ ১৪৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মসনদে বসেন।
তিনি সুবিশাল রাজ্যের অধিকারী ছিলেন। তার মুদ্রায় খলিফাত উল্লাহ- বিন হুজ্জত-ওয়াল বুরহান উপাধি দেখা যায়। তিনি ছিলেন জ্ঞানী, চরিত্রবান, ধর্মপরায়ণ ও প্রজাবৎসল।
ঐতিহাসিকগণ তার রাজত্বকালকে বাংলায় মুসলিম শাসনের একটি গৌরবময় অধ্যায় বলে অভিহিত করেছেন। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর রাজত্ব করার পর ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
৮. রুকনউদ্দিন বরবক শাহ : নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি একদিকে ছিলেন সাহসী যোদ্ধা অপরদিকে ছিলেন।
বিছন, ন্যায়পরায়ণ ও শিল্পানুরাগী নরপতি। তার আমলে মালাধর বসু 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' লিখতে শুরু করেন।
তাছাড়া তার সময়ে স্থাপত্যকলার বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর রাজত্ব করার পর ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
৯. শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ : বরবক শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। তিনি বিচক্ষণ, ধৈর্যশীল, প্রজাহিতৈষী ও ধর্মভীরু ছিলেন।
ছোট পাণ্ডুয়ার স্থাপত্য কীর্তির পরিচয় বহন করে। সাত বছর কৃতিত্বে শাসে রাজত্ব করে ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১০. সিকান্দর শাহ : ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু মস্তিষ্ক বিকৃতির জন্য অল্পদিন পরেই তাকে অপসারিত করে ইউসুফ শাহের অন্য পুত্র জালালউদ্দিন ফতেহ শাহকে সিংহাসনে বসানো হয়।
১১. জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ : শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তার চাচা জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তার সময় হাবশিরা রাজ্যের শান্তি ও | নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে।
তাই তিনি তাদের দমন করতে কৃতসংকল্প হন। হাবশী ক্রীতদাসদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব করতে গিয়ে তিনি নিজেই তাদের হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর সাথে সাথে স্বাধীন ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটে।
→ ইলিয়াস শাহী বংশের পতন : রুকনউদ্দিন বরবক শাহ ও ইউসুফ শাহের শাসনকালে হাবশী ক্রীতদাসদের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। এসময় হাবশী ক্রীতদাসগণ বিভিন্ন উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিল।
অকস্মাৎ অত্যধিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তারা উদ্ধৃত হয়ে ওঠে। ফতেহ শাহ তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে মনস্থ করলেন এবং উদ্ধত দাসদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন।
ফলে বিরোধীদল ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রাসাদরক্ষীরা সুলতান শাহজাদাকে দলভুক্ত করে ফতেহ শাহকে হত্যা করে এবং হত্যাকারী হাবশী ক্রীতদাস সুলতান শাহজাদা বরবক শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
এভাবে বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের গৌরবময় শাসনের অবসান ঘটে এবং হাবশী ক্রীতদাসদের শাসনের সূচনা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগীয় বাংলার মুসলিম শাসনের ইতিহাসে ইলিয়াসশাহী বংশের শাসনকাল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
এ যুগে জ্ঞানবিজ্ঞান, ভাষা-সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। এ যুগে মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণে বাংলার সংস্কৃতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়।