বাংলায় আফগান শাসন প্রতিষ্ঠা করেন কে এর পটভূমি ব্যাখ্যা কর
বাংলায় আফগান শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমি ব্যাখ্যা কর |
বাংলায় আফগান শাসন প্রতিষ্ঠা করেন কে এর পটভূমি ব্যাখ্যা কর
- অথবা, বাংলায় আফগান শাসন প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলা একটি প্রাচীন জনপদের নাম। ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে বহু রাজবংশ বা জাতি বাংলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং বাংলা শাসন করেছেন।
এই শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে আফগান জাতি অন্যতম। তারা তাদের সামরিক সক্ষমতার কারণে বাংলায় আফগান শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আফগান জাতি যে কতটা দুর্ধর্ষ ছিল তা বাংলায় আফগান শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমি দেখলেই অনুধাবন করা যায় ।
→ আফগান-শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমি : মুঘল যুগের অবসানের পর, আফগান শাসন প্রতিষ্ঠা মধ্য যুগে বাংলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। শের খান শূর ছিলেন আফগান শাসনের প্রতিষ্ঠাতা।
তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আফগান শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুঘলদের শাসনের অবসান ঘটে এবং আফগান প্রাধান্য পুনঃস্থাপনের প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছিল। যা বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রে নব অধ্যায় সূচিত হয়।
বাংলায় আফগান শাসন : বাংলায় আফগান শাসনকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. শূর আফগান শাসন ও
২. কররানী আফগান শাসন।
→ শূর আফগান শাসন : নিম্নে শূর আফগান শাসনের বর্ণনা দেওয়া হলো :
১. শের শাহ : আফগান শাসনের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহের নাম ফরিদ। তিনি ভাগ্যান্বেষণে গৃহত্যাগ করে জৈনপুরে চলে আসেন। সেখানে তিনি বাহার খান লোহানীর অধীনে চাকরি করেন।
পরবর্তীতে বাহার খানের মৃত্যু হলে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৫৩৭ সালে তিনি গৌড় অবরোধ করেন এবং ১৫৩৮ গৌড় জয় করেন।
2. ইসলাম শাহ : শের শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র জালাল খান সুর ইসলাম শাহ নাম ধারণ করে সুলতান হন এবং আট বছর রাজত্ব। করেন। তিনি তার পিতার প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থাই বহাল রাখেন।
৩. ফিরোজ শাহ : ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর তার ১২ বছরের পুত্র ফিরোজ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং তার চাচাতো ভাই সুধারিজ কর্তৃক নিহত হন।
৪. আহমদ শুর শাহ : ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে আফগানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। এই সুযোগে বাংলার শাসনকর্তা মোহাম্মদ শাহ চট্টগ্রাম, মগরাজ্য, জৈনপুর ও চুনার অধিকার করেন। কিন্তু মোহাম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতির হাতে নিহত হন।
৫. বাহাদুর শাহ : মুহাম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাহাদুর শাহ গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণের পর তার সুরুজগড়ের অনতিদূরে ফতেহপুর নামক স্থানে শূরকে পরাজিত ও নিহত করেন। বাহাদুর শাহ ১৫৫০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
৬. জালাল শাহ শুর : বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর জালাল উদ্দিন দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
১৫৬৩ সালে মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাকে হত্যা করে কররানী বংশের তাজখান কররানী সিংহাসনে আরোহণ করেন।
৭. কররানী আফগান শাসন : কররানী আফগান জাতির একটি শাখা। ১৫৬৪ সালে গৌড় দখল করে বাংলায় কররানী শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
নিম্নে এ শাসনের বর্ণনা দেয়া হলো :
(ক) তাজখান কররানী : তালখান কররানী প্রথম জীবনে আফগানদের অধীনে থাকলেও নিজ যোগ্যতাবলে ১৫৬৪ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। তবে তার যথেষ্ট কৃতিত্ব রয়েছে। মাত্র এক বছর পরে তার মৃত্যু হয়। ফলে তার শাসনকাল দীর্ঘ হয়নি।
(খ) সুলাইমান কররানী : তাজখানের মৃত্যুর পর তার ভাই সুলাইমান কররানী ১৫৬৫ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তার রাজধানী গৌড় হতে মালদহে স্থানান্তর করেন।
তার অন্যতম সেনাপতি ছিলেন কালাপাহাড়। তিনি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করেন। ১৫৭২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
(গ) বায়েজিদ কররানী : সোলাইমান কররানীর মৃত্যুর পর তার জ্যৈষ্ঠপুত্র বায়েজিদ কররানী সিংহাসনে আরোহণ করে। তিনি ছিলেন উদ্ধত ও উগ্র স্বভাবের। উজির লোদির হাতে তিনি নিহত হন।
(ঘ) দাউদ কররানী : বাংলার শেষ স্বাধীন নরপতি হলেন দাউদ কররানী। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। ফলে তার সাথে বিভিন্ন কারণে সম্রাট আকবরের সংঘর্ষ হয়। ১৫৭৫ সালে আফগান এবং মুঘলদের মধ্যে যুদ্ধ হয়।
এই যুদ্ধের ফলে উভয়ের মধ্যে চুক্তি হয়। এরপর ১৭৭৬ সালে উভয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দাউদ কররানী পরাজিত হয় এবং নিহত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আফগান শাসন বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আফগানরা ছিল দুর্ধর্ষ জাতি। তারা বহু বছর বাংলা শাসন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তবে সমাজব্যবস্থা বা রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব দেখাতে পারেনি। দাউদ খানের পরাজয়ের সাথে সাথে আফগানদের সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটে।