বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর

বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর
বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর

বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকাল পর্যালোচনা কর

  • অথবা, বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
  • অথবা, বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব সম্পর্কে যা জান লিখ ।

উত্তর : ভূমিকা : সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। পিতার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি সুদীর্ঘ তেতত্রিশ বছর পর্যন্ত বাংলায় রাজত্ব করেন। 

বাংলার আর কোনো সুলতান এত বেশি দিন রাজত্ব করেননি। কিন্তু তার রাজত্বকালের কিছু মুদ্রা ও কয়েকটি শিলালিপি ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। 

তবু তার দীর্ঘ সময়ব্যাপী রাজত্বকাল থেকে ধারণা করা যায় যে, তিনি বাংলার মুসলিম শাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সিকান্দার শাহের সিংহাসনারোহণ : সুলতান ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

রাজ্যের আমীর ও সেনাপতিগণ সিকান্দার শান্ত সিংহাসনে আরোহণের ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। ফলে সিংহাসন নিয়ে কোনো রক্তপাত ঘটেনি। 

তিনি বাংলার মুসলিম শাসনের ইতিহাসে সর্বাধিককালে রাজত্ব করেন। ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ বছরের শাসনে তিনি বাংলায় মুসলিম শাসনকে সুদৃঢ়ভাবে কারেণ করেন ।

→ বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের রাজত্বকাল/ কৃতিত্ব : নিম্নে বাংলার সুলতান সিকান্দর শাহের রাজত্বকাল কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো।

১. ফিরোজ শাহের সাথে সম্পর্ক : সিকান্দার শাহ সিংহাসন লাভ করার পর দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক দ্বিতীয়বারের মতো বাংলা অভিযান করেন। 

১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ৭০ হাজার অশ্বারোহী, ৪৭০টি হাতি এবং লক্ষাধিক পদাতিক সৈন্য নিয়ে এ অভিযান পরিচালনা করেন। 

সিকন্দার শাহ এ সংবাদ পেরো রাজধানী পাণ্ডুয়া ছেড়ে একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার পর জয়-পরাজয় অনিশ্চিত থাকে। 

তাই উপায়ন্তর না দেখে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। ফলে সিকান্দার শাহ স্বাধীনভাবে শান্তিতে দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেন। 

ফিরোজ শাহ ৮০,০০০ টাকা দামের একটি মুকুট এবং ৫০টি তরবারি ও তুর্কি ঘোড়া সিকান্দার শাহকে উপহার দেন অপরপক্ষে, সিকান্দার শাহও ৪০টি হাতি ও অন্যান্য বহু মূল্যবান উপঢৌকন দিল্লিতে প্রেরণ করেন।

২. সাহসী সেনানায়ক সিকান্দার শাহ : বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাসে সর্বাধিককাল রাজত্ব করেন। তিনি একজন সাহসী ও সমরকুশলী সেনানায়ক ছিলেন। 

তিনি সাফল্যজনকভাবে দিল্লি বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাংলাকে রক্ষা করেন এবং এর অখণ্ডতাকে অটুট রাখেন। 

আর তাই ফিরোজ শাহ প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার অধিকতর প্রস্তুতি নিয়েও সিকান্দার শাহকে উচ্ছেদ করতে পারেননি। 

ফিরোজ শাহের দ্বিতীয়বারের অভিযানের স্বায়ীত্বকাল ছিল দুই বছর সাত মাস। কিন্তু ফিরোজ শাহের এ দীর্ঘ অবস্থানে সিকান্দার শাহ মোটেই বিচলিত হননি। 

ইলিয়াস শাহ খণ্ড যুদ্ধে দিল্লি বাহিনীর কাছে পরাভূত হয়েছিলেন। কিন্তু সিকাদার শাহ তাদের কাছে সামান্যতম পরাজয়ও বরণ করেননি। 

এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, ইলিয়াস শাহের তুলনায় সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব কোনো অংশে কম নয়।

৩. সুশাসক : সুশাসক হিসেবে সুলতান সিকান্দার শাহের নাম অবিস্মরণীয়। তিনি একজন প্রজাহিতৈষী সুশাসক ছিলেন। তিনি পিতার মতোই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।

রাজ্যে অভ্যন্তরীণ কাঠামো সুগঠিত করে তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সিকান্দার শাহের মুদ্রা প্রবর্তন থেকে অনুধাবন করা যায়, তার সময়ে প্রজাসাধারণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতো।

৪. প্রজাহিতৈষী : সুলতান সিকান্দার শাহ প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি সুফি ও দরবেশদেরকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাদের সম্মানে মসজিদও নির্মাণ করেন। 

শিলালিপি থেকে জানা যায়, সিকান্দার শাহ ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলার দেবকোটে মোড়া আতার দরগাহে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সিকান্দার শাহের মুদ্রা প্রবর্তক থেকে অনুধাবন তার সময়ে প্রজাগণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতো।

৫. স্থাপত্যশিল্পের অনুরাগী : সিকান্দার শাহ স্থাপত্যশিল্পের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এ পর্যন্ত সিকান্দার শাহের শিলালিপি এবং বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। 

তার শাসনকালে নির্মিত প্রাসান, মিনার, হামাস ও মসজিদের ধ্বংসস্তূপের নিদর্শন থেকে | ধারণা করা যায়, তিনি অত্যন্ত শিল্পানুরাগী ও শিল্পস্রষ্টা ছিলেন। 

এ সকল শিল্প ও স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিন, দিনাজপুর জেলার দেবকোটে 'মোল্লা আতার মনজিল, পির সিরাজউদ্দিনের মসজিদ ও তৎসংলগ্ন সমাধিসৌধ, গৌড়ের কোতয়ালি দরওয়াজা এবং হুগলিতে মোল্লা সিমলাইয়ের মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

আয়তনের বিশালতায় আদিনা মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাসে অতুলনীয়। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদটি ১৩৬৪ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। 

এ মসজিদটি ৫০৭ ফুট দীর্ঘ এবং ২৫৮ ফুট প্রশস্ত আর কারুকার্যময় গুল্পশোভিত । এছাড়া একলাখি মসজিদের ধ্বংসাবশের মধ্যে আজো বহু দেবদেবীর ভগ্নাংশ দেখতে পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনো হিন্দু মন্দিরের উপর এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

৬. মুদ্রা প্রবর্তক : সিকান্দার শাহ ১৩৫৮ থেকে ১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুদ্রা জারি করেন। তার প্রবর্তিত মুদ্রা বা শিলালিপিতে তার কোনো পূর্ণ রাজকীয় নামের উল্লেখ নেই। 

তিনি 'আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ' নামে মুদ্রা বা শিলালিপি উৎকীর্ণ করেছেন। অন্যত্র পাওয়া যায়, তিনি 'সুলতান-উল-আজম' এবং ‘সুলতান-উল-মুয়াজ্জম' উপাধি ধারণ করেছিলেন। 

আবার কোনো কোনো মুদ্রায় 'আল মুজাহিদ-ফি-সবীল-উর রহমান' বলে দাবি করেছেন। আবার কোনো কোনো মুদ্রায় ‘ইমাম-উল-আজম' উপাধি গ্রহণ করেছেন। এ সকল উপাধি দ্বারা ধারণা করা হয়, তিনি ধর্ম বিষয়ে ও মুঘলমানদের নেতৃত্বের দাবি করতেন।

৭. স্বাধীনচেতা : সুলতান সিকান্দার শাহ একজন স্বাধীনচেতা নরপতি ছিলেন। দিল্লির অধিপতি ফিরোজ শাহ যখন সিকান্দার শাহের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে তার বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন তখন সিকান্দার শাহ ছলে বলে কৌশলে ফিরোজ শাহকে সন্ধির প্রস্তাবে আবদ্ধ করে নিজ স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখেন। তিনি নিজ মুদ্রা ও খুতবা পাঠ করান।

৮. নিষ্ঠাবান মুসলমান : সিকান্দার শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তাই সুফি-দরবেশগণ সব সময় তার দরবার অলংকৃত করতেন। শিলালিপি থেকে জানা যায়, সিকাদার শহ ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলায় দেবকোটে মোল্লা আতার দরগাহে একখানি মসজিদ নির্মাণ করেন। 

মসজিদ নির্মাণের প্রতি আগ্রহ থেকে বুঝা যায়, তিনি ধর্মের প্রতি অত্যন্ত আস্থাশীল ছিলেন। মুসলিম সুফি-দরবেশদের প্রতিও তার গভীর শ্রদ্ধার ছিল। মাওলানা মুজাফফর শামস্ বলখির চিঠিতে জানা যায় যে, সিকান্দার শাহের সাথে শেখ শরফউদ্দিন মনোরীর সৌহার্দ্য ও পত্রালাপ ছিল ।

৯. বিদ্যার পৃষ্ঠপোষকতা : সুলতান সিকান্দার শাহ যথেষ্ট বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞান ব্যক্তি তার দরবারে আশ্রয় লাভ করে। 

তারা শাসনকার্যে সুলতানকে পরামর্শ প্রদান করতেন। শেখ আলাউল তার সমসাময়িক ছিলেন। এবং তার পৃষ্ঠপোষকতায় পাণ্ডুয়ায় বাস করতেন।

১০. সিকান্দার শাহের চরিত্র : ইলিয়াস শাহী বংশের অন্যতম শাসক সিকান্দার শাহের চরিত্রে নম্রতা, ভদ্রতা, একাগ্রতা, দৃঢ়তা, ধর্মনিষ্ঠা প্রভৃতি গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। 

তিনি স্বীয় সাম্রাজ্যকে বহিরাক্রমণ বিশেষ করে দিল্লির ফিরোজ শাহের কোপানল থেকে নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন। তার গৃহীত এ নীতির মধ্য দিয়ে তার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। 

তিনি সর্বদা রাজ্য ও প্রজার কল্যাণে উদগ্রীব থাকতেন। জ্ঞানচর্চা ছিল তার নেশা। এজন্য রাজ্যের জ্ঞানী-গুণীরা তার দরবারে সমবেত হতেন।

১১. সিকান্দার শাহের শেষ জীবন : সিকান্দার শাহের আঠার জন পুত্র সন্তান ছিল। তারা প্রায়ই বিভিন্ন কারণে আত্মকলহে লিপ্ত থাকত। পুত্রদের মধ্যে আত্মকলহ সিকান্দার শাহের শেষ জীবনকে বিষাদময় করে তুলেছিল। 

তাই সিকান্দার শাহের শেষ জীবন সুখের হয়নি। সিকন্দার শাহের পুত্র গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ বিমাতার চক্রান্তে বিদ্রোহী হন এবং পিতা ও পুত্রের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় তাতে সিকান্দার শাহ পরাজিত ও নিহত হন। তার মৃত্যুর তারিখ সঠিক জানা যায় না।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সিকান্দার শাহের রাজত্বকালের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া না গেলেও একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, তিনি বাংলায় পিতৃরাজ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন এবং তার শাসনামলে দেশে শান্তি বিরাজ করছিল। 

ইলিয়াস শাহ কর্তৃক প্রবর্তিত স্বাধীন সুলতানি আমল 'দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করে সিকান্দার শাহের শাসনকালে। তাই বাংলায় ইতিহাসে সিকান্দার শাহের নাম স্মরণীয়। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ