বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে রাজা গণেশের ভূমিকা কি ছিল
বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে রাজা গণেশের ভূমিকা কি ছিল |
বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে রাজা গণেশের ভূমিকা কি ছিল
- অথবা, রাজা গণেশ কে ছিলেন? বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে তার ভূমিকা নির্ণয় কর।
- অথবা, রাজা গণেশের পরিচয় দাও। বাংলার রাজনীতিতে রাজা গণেশের ভূমিকা তুলে ধর।
উত্তর : ভূমিকা : ৮১৭ হিজরি (১৪১৪-১৫ খ্রিষ্টাব্দ) সালের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজা গণেশ ও তার বংশধরগণ প্রায় ত্রিশ বৎসরকাল তাদের শাসন বজায় রেখেছিলেন।
রাজা গণেশের ইতিহাস পুনরুদ্ধার কষ্টসাধ্য। কারণ সমসাময়িক কালের কোনো ইতিহাস নেই বললেই চলে। কিংবদন্তী ও কুলপঞ্জিতে রাজা গণেশ সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় ।
রাজা গণেশ বাংলায় হিন্দু শাসনের যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন তার মৃত্যুর সাথে সাথে এই হিন্দু রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।
রাজা গণেশের পরিচয় : নিম্নে রাজা গণেশের পরিচয় আলোচনা করা হলো :
১. জমিদার রাজা গণেশ : সমসাময়িক তথ্যের অভাবে রাজা গণেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। যে সমস্ত সূত্রের মধ্যে গণেশ ও তার বংশের ইতিহাস পাওয়া যায় তাদের মধ্যে আবুল ফজল রচিত 'আইন-ই-আকবরী, 'নিজামউদ্দিন বখশী রচিত তাকত-ই-আকবরী।
তারিক-ই-ফিরিশতা, গোলাম হোসেন সলিম রচিত রিয়াজ-উস-সালাতীন উল্লেখযোগ্য। রিয়াজ-উস- সালাতিনের মতে গণেশ ছিলেন ভাতুড়িয়ার জমিদার। বাংলার শাসন ক্ষমতা হস্তগত করার পূর্বে গণেশ ইলিয়াসশাহী নুলতানদের অমাত্য ছিলেন।
২. গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যু : সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুতে আমরা প্রথমেই গণেশের নাম উল্লেখ পাই। এর পরবর্তী সুলতানদের সময়ে তাঁকে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন অমাত্য হিসেবে দেখতে পাই। এই সময়ে গণেশের ক্রমাগত ক্ষমতার বৃদ্ধির পরিণতি হয়েছিল বাংলার সিংহাসন অধিকার।
৩. ইব্রাহিম শর্কীর আক্রমণ : ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন উচ্ছেদ করে রাজা পপেশ নিজেই সিংহাসনে বসেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুঘলমান দরবেশদের সাথে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়।
গণেশ অনেক মুসলমান দরবেশদেরকে হত্যা করেন। দরবেশদের নেতা নূর কুতুব আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীকে বাংলা আক্রমণের আহ্বান জানান।
সুলতান ইব্রাহিম সসৈন্যে বাংলায় উপস্থিত হলে রাজা গণেশ নতি স্বীকার করেন এবং নূর কুতুব আলমের সঙ্গে আপোস করেন।
৪. সিংহাসনে পুনঃআরোহণ : রাজা গণেশ কর্তৃক দ্বিতীয় বার সিংহাসন অধিকারের উল্লেখ আছে। সুলতান ইব্রাহীম শর্কীর প্রত্যাবর্তনের পর পরই রাজা গণেশ শাসনদণ্ড পরিচালনা আরম্ভ করেন এবং পুত্র যদুকে সুবর্ণধেনু ব্রত দ্বারা পুনরায় হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করেন।
নিজ পুত্র যদুকে সিংহাসনচ্যুত করে তিনি পুনরায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। এবারও গণেশ দরবেশদেরকে কঠোরহস্তে দমন করেন। এই সময়ে গণেশ গৌরবসূচক- 'দনুজমর্দন' এবং 'চন্ডীচরণপরায়ণ' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
৫. হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষক : হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার দিক দিয়ে গণেশের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু। তিনি মুদ্রায় 'চণ্ডীচরণ পরাণস্য' শব্দ খোলাই করেন।
পত্রাদি থেকে জানা যায় যে রাজা গণেশ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতির পুনরুভ্যুদয় ঘটন।
৬. গোঁড়া হিন্দু শাসক : রাজা গণেশ ছিলেন একজন পোড়া হিন্দু শাসক। রাজ্যের শাসনব্যবস্থা থেকে তিনি সকল মুঘলমান কর্মচারীদেরকে অপসারণ করে সেই জায়গায় হিন্দু ধর্মীয় লোক নিয়োগ করেন।
ধর্মীয় রাজনীতির প্রয়োজনে তিনি বহু ইসলামিক প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ ধ্বংস করেন এবং অনেক মুঘলমান জনগণ ও দরবেশদের উপর অত্যাচার করেন।
মুঘলমানদের ঐতিহ্য সম্পর্কিত প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন আদিনা মসজিদকে ধ্বংস করে দিয়ে গণেশ উহাকে কাছারি বাড়িতে পরিণত করেন।
৭. মুদ্রা আরি : রাজা গণেশ সনুজমর্দন নাম ধারণ করে ঐ নামে মুদ্রা জারি করেন। এ মুদ্রাগুলোর এক পিঠে রাজার নাম আর অপর পিঠে টাকশালের নাম, তারিখ ও চন্ডিচরণ পরায়ণসু লেখা আছে।
৮. গণেশের মৃত্যু : মুদ্রার সাক্ষ্যে বলা যায় ১৪১৮ খ্রি কোনো এক সময়ে রাজা গণেশের মৃত্যু হয়। কারণ এরপর তার আর কোনো মুদ্রা পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিক ফিরিস্তার বর্ণনায়, “গণেশ সাত বছর রাজত্ব করেন।”
আরবি ঐতিহাসিক ইবনে হাজরের ‘ইনবাউল গুমর' থেকে জানা যায়, গণেশের পুত্র আলাল উদ্দিন গণেশকে আক্রমণ করে হত্যা করে।লা যে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই হোক, আর যে- কেনো প্রতিভার কারণেই হোক বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাসে দেশের উত্থান চির ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
একক কৃতিত্বের দিক দিয়ে দেশের সঙ্গে খুব কমসংখ্যক লোকেরই তুলনা চলে। করে তিনি যে বাংলার মুঘলমানদের প্রতি নিপীড়নমূলক নীতি গ্রহণ করছলেন এবং মুসলিম সংস্কৃতি অবকাঠামো ধ্বংসের পথে নিয়ে হলে, সমাজ সংস্কৃতির ক্ষতি সাধন করেছিলেন তার জন ইতিহাস তাকে চিরকাল ধিক্কার দিয়ে যাবে।
বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে রাজা গণেশের ভূমিকা : শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের রাজত্বকাল থেকে বাংলার সুলতানদের রাজদরবারে হিন্দু অমাত্যে ও জমিদাররা একটি করে নেয়।
এদের মধ্যে রাজা গণেশের নাম উল্লেখযোগ্য। মুঘলমানদের উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের সুযোগে তিনি ধীরে ধীরে রাজকীয় উচ্চ পদে আসীন হন।
এক পর্যায়ে তিনি রাজক্ষমতা দখলের জন্য কৌশল অবলম্বন করেন। সমকালীন বাংলার রাজনীতিতে তার ভূমিকা অনেক।
নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. দক্ষ কূটনীতিবিদ : রাজা গণেশ ছিলেন একজন দক্ষ কূটনীতিবিদ। তাই সুলতান ইব্রাহীম শর্কি যখন বাংলা আক্রমণ করেন তখন তিনি প্রতিরোধ অসম্ভব জেনে সুলতানের কাছে আনুগত্য স্বীকার করেন এবং পুত্রকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে বাংলার সিংহাসনে স্বীয় অধিপতা অক্ষুণ্ণ রাখেন।
তিনি ইব্রহিম শর্কি প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে তিনি নিজ ক্ষমতা নিরাপদ ভাবার পর পুত্রকে সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি পুনরায় হিন্দু শাসন কায়েম করেন।
২. মুঘলমানদের সমর্থন লাভ : রাজা গণেশ সুলতানি যুগে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এ সময় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন চলে।
তাই রাজা গণেশ ক্ষমতায় আরোহণ করেই মুসলমানদের ভালোবাসা ও সমর্থন লাভ করার চেষ্টা করেন।
ঐতিহাসিক ফিরিশতার বিবরণ থেকে রাজা গণেশের মুঘলমানদের প্রতি অনুকূল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
৩. হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা : রাজা গণেশ ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু। স্বীয় মুদ্রায় চণ্ডী চরণপরাণস্য শব্দ খোদাই এবং ব্রাহ্মণ পন্থনাকের চরন পূজা তার ধর্মীয় নিষ্ঠার পরিচায়ক। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি সারা বালায় হিন্দু শাসন প্রবর্তন করেন।
এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রশাসনের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ইলমানদের অপসারণ করে সে স্থলে হিন্দুদের নিয়োগ করেন। তর শাসন কাঠামোতেও হিন্দুকরণের পরিচয় পাওয়া যায় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রাজা গণেশ সমকালীন বাংলার রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। বাংলায় দীর্ঘ তুসলিম অধিপত্যের যুগে তার হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠা ব্যাপক কৃতিে পরিচারক।
তিনি একজন প্রতিভাসম্পন্ন কূটনীতিক এবং দু শক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন বলেই তার পক্ষে মুসলিম শাসনামলে হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। যদিও মুসলমানদের বলিষ্ঠ। প্রতিরোধের মুখে রাজা গণেশের বড় স্থায়ী আসন লাভ করেনি।