বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর |
বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
- অথবা, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দার শাহের আমলে বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবদান আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং সিকান্দার শাহ বিশেষভাবে স্মরণীয়। দিল্লি সালতানাতের দুবলতার সুযোগে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ প্রভু সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করে পশ্চিম বাংলার সিংহাসনে বসেন।
অতঃপর অসাধারণ কৃতিত্ব এবং দক্ষতার সাথে একটি স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আর পিতার মতোই অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন সুলতান সিকান্দার শাহ ।
→ শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সিংহাসনারোহণ : শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূর্বনাম ছিল হাজী ইলিয়াস। তিনি ছিলেন পূর্ব ইরানের অধিবাসী।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ফিরোজ শাহের এক নগণ্য কর্মচারী এবং পরবর্তীতে সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী চতুর হাজী ইলিয়াস সেনাবাহিনীকে বশীভূত করে খোজাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে প্রভু আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করেন এবং 'শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ' উপাধি ধারণ করে স্বাধীন সুলতানরূপে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি স্বীয় দক্ষতাবলে ১৫ বছর স্বাধীন সুলতান রূপে অধিষ্ঠিত থেকে ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ।
→ বাংলার রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিতে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের কৃতিত্ব/অবদান : ইলিয়াস শাহের সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে বাংলায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
নিম্নে বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে তার কৃতিত্ব/অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান : সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ছিলেন সমগ্র বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। অসামান্য দক্ষতা এবং যোগ্যতার বলেই তিনি সামান্য কর্মচারী থেকে রাজাধিপতি হতে পেরেছিলেন। 'সুলতান-ই-বাংলা' এবং শাহ-ই- বাংলা নাম ধারণ করে তিনি বাংলার সিংহাসনে বসেন।
২. শ্ৰেষ্ঠ বিজেতা : শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ছিলেন একজন সক্ষ সৈনিক এবং শ্রেষ্ঠ বিজেতা। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি রাজ্যবিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন।
তিনি ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপাল আক্রমণ করে প্রচুর ধন-সম্পদ হস্তগত করেন। ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ববঙ্গের শাসনকর্তা ফখরুদ্দিন মুবারক শাহকে পরাজিত করে সোনারগাও দখল করেন।
১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিহার জন্ম করেন এবং ১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কামরূপ অভিযান করে অদখল করেন।
৩. সুযোগ্য শাসক : সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ছিলেন একজন বিচক্ষণ ও জনপ্রিয় শাসক। রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে তিনি। প্রজাসাধারণের কল্যাণের প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন।
তাই তার রাজত্বকালে বাংলায় শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি বিরাজ করছিল। সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ইলিয়াস শাহের রাজত্বকাল স্মরণীয় হয়ে আছে।
৪. রাজনৈতিক দূরদর্শিতা : ইলিয়াস শাহ ছিলেন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং ফিরোজ শাহ তুঘলকের সাথে সন্ধি স্থাপন তার অপরিসীম রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে।
রাজধানী দিল্লির সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে তিনি বাংলার রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ নিষ্কন্টক করেন।
৫. স্বদেশী শাসন প্রতিষ্ঠা : ইলিয়াস শাহ এমন এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা যে বংশের সুলতানরা দেশীয় লোকদের সাথে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে তাদের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এ সহযোগিতার ফলেই দিল্লির আক্রমণ প্রতিহত করার মতো শক্তিও তারা পেয়েছিলেন। তাছাড়া ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনামলে বাংলার মুসলিম রাজ্য বিদেশি শাসনের প্রকৃতি ত্যাগ করে দেশীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে ভাল মিলিয়ে এ দেশীয় রাজ্যে পরিণত হয়।
৬. ভৌগোলিক পূর্ণতা দান : তিনি তিন খণ্ডে বিভক্ত বাংলাকে সাতগাঁও, সোনারগাঁও এবং লখনৌতি একত্রিত করে বৃহত্তর বাংলার একক ভৌগোলিক রূপদান করেছিলেন। এজন্যই তাকে ন্যায়সঙ্গতভাবে জাতীয় ঐক্যের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
৭. বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা : ইলিয়াস শাহকে মধ্যযুগের মুসলিম বাংলার ইতিহাসে প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা বলা হয়। তার রাজত্বকালেই বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় থেকেই বাংলার সকল অঞ্চলের অধিবাসী বাঙালি বলে পরিচিত হয়।
৮. যোগ্য সংগঠন : সুলতান ইলিয়াস শাহ একজন যোগ্য সংগঠক ছিলেন বলেই তিনি রাজদরবারে অবস্থানকালে নিজের সমর্থক তৈরি করতে পেরেছিলেন এবং যথাসময়ে তাদের সহায়তায় সিংহাসন দখল করেন।
৯. স্থাপত্যশিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা : ইলিয়াস শাহ স্থাপত্যশিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি 'হাজীপুর' নামে একটি শহর ও ফিরোজাবাদে একটি 'হাম্মামখানা' নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া সুফি সাধক আলাউল হকের সন্মানে মসজিদ নির্মাণ করে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে।
১০. শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা : রাজনীতির মতো শিক্ষা ও সাহিত্যেও ইলিয়াস শাহের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। বহু কবি, সাহিত্যিক এবং পণ্ডিত ব্যক্তি তার দরবার অলকৃত করতেন।
১১. জনহিতকর কার্যাবলি : ইলিয়াস শাহ বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদনের মাধ্যমে বিশেষ স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি প্রজাদের উন্নতি কল্পে বহু সড়ক, রাস্তাঘাট, সেতু ও সরাইখানা এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের বহু খাল খনন করেন।
১২. ধর্মভীরুতা : সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ একজন উদারমনা ও ধর্মভীরু শাসক ছিলেন। নিজে একনিষ্ঠ মুসলিম হয়েও অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর ছিল সহিষ্ণুতা।
অনেক পীর, ফকির ও মুফি দরবেশ তার দরবারে স্থান পেত এবং তারা ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
তিনি প্রজাদের নাগরিক সুবিধা ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। ফলে সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে হিন্দু- মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে উঠে।
১৩. সিকান্দার শাহের সিংহাসনারোহণ : ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
রাজ্যের আমীর ও সেনাপতিগণ সিকান্দার শহকে সিংহাসনে আরোহণের ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। ফলে সিংহাসন নিয়ে কোনো রক্তপাত ঘটেনি।
তিনি বাংলার মুসলিম শাসনের ইতিহাসে সর্বাধিককাল রাজত্ব করেন। ১৩৫৮ থেকে ১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ বছরের শাসনে তিনি বাংলায় মুসলিম শাসনকে সুদৃঢ়ভাবে কায়েম করেন।
→ বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব/অবদান : বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সিকান্দার শাহের অবদান উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার সবচেয়ে বড় অবদান। হলো দিল্লির সুলতানের আক্রমণ থেকে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করা।
নিম্নে বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে তার কৃতিত্ব/অবদান আলোচনা করা হলো :
১. ফিরোজ শাহের সাথে সম্পর্ক : সিকান্দার শাহ সিংহাসন লাভ করার পর দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক দ্বিতীয়বারের মতো বাংলা অভিযান করেন।
১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ৭০ হাজার অশ্বারোহী, ৪৭০টি হাতি এবং লক্ষাধিক পদাতিক সৈন্য নিয়ে এ অভিযান প্রেরণ করেন।
সিকান্দার শাহ এ সংবাদ পেয়ে রাজধানী। পান্ডুয়া ছেড়ে একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার পর জয়-পরাজয় অনিশ্চিত থাকে।
তাই উপায়ন্তর না দেখে উত্তরপক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। ফলে সিকান্দার শাহ স্বাধীনভাবে শান্তিতে গ্রীষ্মদিন দেশ শাসন করেন।
ফিরোজ শাহ ৮০,০০০ টাকা দামের একটি মুকুট এবং ৫০টি তরবারি ও তুর্কি ঘোড়া সিকান্দার শাহকে উপহার নেন। অপরপক্ষে, সিকান্দার শাহ ও ৪০টি হাতি ও অন্যান্য বহু মূল্যবান উপঢৌকন দিল্লিতে প্রেরণ করেন।
২. সাহসী সেনানায়ক : সিকান্দার শাহ বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাসে সর্বাধিককাল রাজত্ব করেন। তিনি একজন সাহসী ও সমরকুশলী সেনানায়ক ছিলেন।
তিনি সাফল্যজনকভাবে দিল্লি বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাংলাকে রক্ষা করেন এবং এর অজ্ঞতাকে অটুট রাখেন। আর তাই ফিরোজ শাহ প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার অধিকতর প্রস্তুতি নিয়েও সিকান্দার শাহকে উচ্ছেদ করতে পারেননি।
ফিরোজ শাহের দ্বিতীয়বারের অভিযানের স্বাধীত্বকাল ছিল দুই বছর সাত মাস। কিন্তু ফিরোজ শাহের এ দীর্ঘ অবস্থানে সিকান্দার শাহ মোটেই বিচলিত হননি। ইলিয়াস শাহ খণ্ড যুদ্ধে দিল্লি বাহিনীর কাছে পরাভূত হয়েছিলেন।
কিন্তু সিকান্দার শাহ তাদের কাছে সামান্যতম পরাজয়ও বরণ করেননি। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, ইলিয়াস শাহের তুলনায় সিকান্দার শাহের কৃতিত্ব কোনো অংশে কম নয়।
৩. সুশাসক : সুশাসক হিসেবে সুলতান সিকান্দার শাহের নাম অবিস্মরণীয়। তিনি একজন প্রজাতৈইতী সুশাসক ছিলেন। তিনি পিতার মতোই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
রাজ্যে অভ্যন্তরীণ কাঠামো সুগঠিত করে তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সিকান্দার শাহের মুদ্রা প্রবর্তন থেকে অনুধাবন করা যায়, তার সময়ে প্রজাসাধারণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতো।
৪. প্রজাহিতৈষী : সুলতান সিকান্দার শাহ প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি সুফি ও দরবেশদেরকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাদের সম্মানে মসজিদও নির্মাণ করেন।
শিলালিপি থেকে জানা যায়, সিকান্দার শাহ ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলার, দেবকোটে মোঘা আভার দরগাহে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সিকান্দার শাহের মুদ্রা প্রবর্তক থেকে অনুধাবন তার সময়ে প্রজাগণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতো।
৫. স্থাপত্যশিল্পের অনুরাগী : সিকান্দার শাহ স্থাপত্যশিল্পের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এ পর্যন্ত সিকান্দার শাহের শিলালিপি এবং বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।
তার শাসনকালে নির্মিত প্রাসাদ, মিনার, হামাস ও মসজিদের ধ্বংসস্তূপের নিদর্শন থেকে ধারণা করা যায়, তিনি অত্যন্ত শিল্পানুরাগী ও শিল্পস্রষ্টা ছিলেন।
এ সকল শিল্প ও স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে পাণ্ডুয়ার আপিনা মসজিদ, দিনাজপুর জেলার দেবকোটে 'মোল্লা আতার মসজিদ, পীর সিরাজউদ্দিনের মসজিদ ও তৎসংলগ্ন সমাধিসৌধ, গৌড়ের কোতয়ালি দরওয়াজা এবং হুগলিতে মোল্লা সিমলাইয়ের মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আয়তনের বিশালতায় আদিনা মসজিদের মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাসে অতুলনীয়। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদটি ১৩৬৪ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। এ মসজিদটি ৫০৭ ফুট দীর্ঘ এবং ২৫৮ ফুট প্রশস্ত আর কারুকার্যময় অল্পশোভিত এ মসজিদটি।
৬. স্বাধীনচেতা : সুলতান সিকান্দার শাহ একজন স্বাধীনচেতা নরপতি ছিলেন। দিল্লির অধিপতি ফিরোজ শাহ যখন সিকান্দার শাহের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে তার বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন তখন সিকান্দার শাহ হলে বলে কৌশলে ফিরোজ শাহকে সন্ধির প্রস্তাবে আবদ্ধ করে নিজ স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখেন। তিনি নিজ মুদ্রা ও খুতবা পাঠ করান।
৭. মুদ্রা প্রবর্তক : সিকান্দার শাহ ১৩৫৮ থেকে ১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুদ্রা জাবি করেন। তার প্রবর্তিত মুদ্রা বা শিলালিপিতে তার কোনো পূর্ণ রাজকীয় নামের উল্লেখ নেই।
তিনি 'আবুল মুজাহি সিকান্দার শাহ' নামে মুদ্রা বা শিলালিপি উৎকীর্ণ করেছেন। অন্যত্র পাওয়া যায়, তিনি 'সুলতান-উল-আজম' এবং 'সুলতান- উল-মুয়াজ্জম' উপাধি ধারণ করেছিলেন।
আবার কোনো কোনো মুদ্রায় 'আল মুজাহিদ-ফি-সবীপ- উপ রহমান' বলে দাবি করেছেন। আবার কোনো কোনো মুদ্রায় ইমাম-উল-আজম' উপাধি গ্রহণ করেছেন। এ সকল উপাধি যারা ধারণা করা হয়, তিনি ধর্ম বিষয়েও মুঘলমানদের নেতৃত্বের দাবি করতেন।
৮. নিষ্ঠাবান মুলমান : সিকাদার শাহ একজন নিষ্ঠাবান | মুঘলমান ছিলেন। তাই সুফি-দরবেশগণ সবসময় তার দরবার অলঙ্কৃত করতেন।
শিলালিপি থেকে জানা যায়, সিকান্দার শাহ ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলায় দেবকোটে মোল্লা আভার দরগাহে একখানি মসজিদ নির্মাণ করেন।
মসজিদ নির্মাণের প্রতি আগ্রহ থেকে বুঝা যায়, তিনি ধর্মের প্রতি অত্যন্ত আস্থাশীল ছিলেন। মুসলিম সুফি-দরবেশদের প্রতিও তার গভীর শ্রদ্ধার ছিল।
মাওলানা মুজাফ্ফর শামস্ বলখির চিঠিতে জানা যায় যে, সিকান্দার শাহের সাথে শেখ শরফউদ্দিন মনোরীর সৌহার্দ্য ও পত্রালাপ ছিল।
৯. বিদ্যার পৃষ্ঠপোষকতা : সুলতান সিকান্দার শাহ যথেষ্ট বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতার অনেক জ্ঞানী-গুণী ও বিধান ব্যক্তি তার দরবারে আশ্রয় লাভ করে।
তারা শাসনকার্যে সুলতানকে পরামর্শ প্রদান করতেন। শেখ আলাউল তার সমসাময়িক ছিলেন এবং তার পৃষ্ঠপোষকতায় পাণ্ডুয়ায় বাস করতেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দার শাহের আমলে বাংলার রাজনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ভাষা এক নতুন রূপ লাভ করে।
স্বীয় বৃদ্ধি, প্রজ্ঞা, শৌর্যবীর্য ও কর্মদক্ষতার বলে ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সিকান্দার শাহ নিজের ক্ষমতাবলে সেখানে ৩৫ বছর আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হন এবং বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন।