বাংলার কররানী বংশের শাসক দাউদ খান কররানীর শাসন সম্পর্কে আলোচনা কর
বাংলার কররানী বংশের শাসক দাউদ খান কররানীর শাসন সম্পর্কে আলোচনা কর |
বাংলার কররানী বংশের শাসক দাউদ খান কররানীর শাসন সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, বাংলার কররানী বংশের শাসক দাউদ খান কররানীর শাসন সম্পর্কে ধারণা দাও।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে কররানী বংশের শাসনামল একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তারা ছিলেন আফগান বা পাঠান জাতির একটি শাখা।
ঐতিহাসিক জন স্টুয়ার্ট বলেন, “শেরশাহ ও তার পুত্র ইসলাম শাহ কর্তৃক আফগান গোত্র বওজীপুর রাজ্য ও খাওয়াসপুর তান্ডার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল লাভ করলে তারা অদ্ভুতভাবে একটি পৃথক বংশের সূচনা করে।”
jadunath Sarkar, "The Bengal Sultanate acquired an unwanted strength under this dynasty and became for a time the one dominating power in north eastern India" - Ref: The History of Bengal. vl-II, P-181]
এ বংশের অন্যতম শাসক হলেন দাউদ খান কররানী। তিনি এ বংশের সর্বশেষ শাসক ছিলেন।
→ দাউদ খান কররানীর শাসন : বায়েজিদ কররানীর মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা দাউদ খান কররানী ১৫৭২ সালে বঙ্গের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন কররানী বংশের শেষ স্বাধীন নরপতি । তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করলে আকবর সেনাপতি মুনিম খানকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। দাউদ সেনাপতি সোনী খান ও গুজার খানের সাহায্যে মুনিম খানকে মূল্যবান উপহার পাঠিয়ে এবং আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে প্রাথমিক মুঘল অভিযান প্রতিহত করেন।
১. মুঘলদের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার : দাউদ খান সিংহাসনে আরোহণের পর পিতার আমলের বিপুল ধনসম্পদ ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী লাভ করেছিলেন।
এটা তাকে গর্বিত ও অহঙ্কারী করে তুলেছিল। তিনি তার পিতার ন্যায় মুঘলদের প্রতি আনুগত্য রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজ নামে পুরা পাঠ ও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন।
এ ব্যাপারে দাউদ খান তার হিতাকাঙ্ক্ষীদের কোনো সৎপরামর্শ গ্রহণ করেননি। পরিণামে তাকে মুঘলদের [বিরুদ্ধে শক্তির দ্বন্যে লিপ্ত হতে হয়েছিল।
২. মুঘলগণ কর্তৃক হাজীপুর ও পাটনা অধিকার : আফগান নায়ক লোদী খান মুঘলদের সাথে হাত মেলালে মুঘল বাহিনী পাটনার সন্নিকটে আসে এবং দাউদের প্রতিরক্ষাব্যূহে অবরোধ করে।
উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর একপর্যায়ে হাজীপুর ও পাটনা ১৫৭৪ সালের ৩ আগস্ট মুঘল কর্তৃক অধিকার হয়ে যায়।
৩. আকবরের সাথে যুদ্ধ : ১৫৭৩ সালে আকবর মুনিম খানের সাহায্যে টোডরমলকে প্রেরণ করেন। দাউদ খানের উজির লোদী খান, কলু লোহানী, গুজার খান এবং শ্রীহরির সাথে একত্রিত হয়ে মুঘল বাহিনীকে প্রতিহত করেন।
অতঃপর মুনিম খান, এক বিশাল বাহিনী নিয়ে দাউদ খানকে আক্রমণ করে। ১৫৭৪ সালে আকবর সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে হাজীপুর অধিকার করেন।
দাউল ভয়ে ডান্ডায় পলায়ন করলে আকবর পাটনা অধিকার করেন। পরে মুঘল বাহিনী ভাঙা অধিকার করে।
১৫৭৫ সালে দাউদ আকবরের বাহিনীর সাথে ডুকোরই যুদ্ধ করে এবং পরিণামে মুঘল বাহিনীর সাথে তার সন্ধি হয়।
৪. তুকোৱাই যুদ্ধ : ১৫৭৫ সালের মার্চ মাসে ডুকোরাই প্রান্তরে দাউদ খান কররানী মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করান।
ডাল্টন স্টেশনের ১১ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে তুর্কোরাইয়ের রণক্ষেত্র অবস্থিত ছিল। প্রতিপক্ষের তুলনায় আফগানগণ তেমন শক্তিশালী ছিল না।
দাউদ খান মুঘলদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব পাঠায়। মুঘল সেনাপতি মুনিম খান তার প্রস্তাব বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে মেনে নেয়।
৫. রাজমহলের যুদ্ধ : মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের মৃত্যু হলে দাউদ কররানী মুঘল আধিপত্য অস্বীকার করেন। ফলে ১৫৭৫ সালে সম্রাট আকবর খানজাহানকে সেনাপতি নিযুক্ত করে বাংলা অভিযানে প্রেরণ করেন।
দাউদ খান মুঘল বাহিনীর সাথে ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধে দাউদখান পরাজিত ও বন্দি হন এবং চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে তাকে হত্যা করা হয়। ফলে বাংলার আফগান স্বাধীন সালতানাত সমাপ্ত হয়।
উপসংহার : দাউদখানের পতনের সাথে সাথে আফগানদের সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটে। এর ফলে বাংলার স্বাধীন সত্তা বিলুপ্ত হয়। কররানী বংশের শাসনামলে বাংলা একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল।
এ বংশের পতনের সাথে বাংলা মুঘল শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। দাউদ খানের পরাজয়ে বঙ্গে আফগানদের সকল প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
এভাবে দ্বিতীয়বার মুঘল বাহিনী বঙ্গে কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। দাউদ খানের পতনের ফলে আফগানদের প্রায় পঞ্চাশ বছরের সার্বভৌমত্বের ও অবসান সূচিত হয়।