বাংলার কররানী বংশের রাজত্বকাল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা কর
বাংলার কররানী বংশের রাজত্বকাল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা কর |
বাংলার কররানী বংশের রাজত্বকাল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা কর
- অথবা, বাংলার কররানী বংশের রাজত্বকাল সম্বন্ধে একটি বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে কররানী বংশের শাসনামল একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তারা ছিলেন আফগান বা পাঠান জাতির একটি শাখা।
ঐতিহাসিক জন স্টুয়ার্ট বলেন, “শেরশাহ ও তার পুত্র ইসলাম শাহ কর্তৃক আফগান গোত্র বওজীপুর রাজ্য ও খাওয়াসপুর ভান্ডার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল লাভ করলে তারা অদ্ভুতভাবে একটি পৃথক বংশের সূচনা করে।”
→ কররানী বংশের রাজত্বকাল : নিম্নে কররানী বংশের রাজত্বকাল সম্পর্কে তুলে ধরা হলো :
কররানী বংশের ক্ষমতা লাভ : শেরশাহের প্রধান অমাত্যবর্গ ও কর্মচারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাজ খান। আদিল শাহের সময় তিনি রাজধানী ছেড়ে দোয়াব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন।
১৫৫৪ সালে আদিল শাহের সেনাপতি হিমু, তাজ খান ও তার ভাইদের সম্মিলিত বাহিনীকে চুনারের সন্নিকটে ‘এক যুদ্ধে পরাজিত করে।
এরপর তাজ খান ও সুলায়মান খান বাংলায় পলায়ন করে এবং ১০ বছরের মধ্যে নানা উপায়ে গৌড়ের অধিকাংশ এবং বিহারের দক্ষিণ পূর্বাংশের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
১৫৬৪ সালে তাজ খান কৌশলে বাংলার শাসনকর্তা তৃতীয় গিয়াস উদ্দিনকে হত্যা করে বাংলার মসনদে আরোহণ করেন। তিনিই ছিলেন বাংলার কররানী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ।
→ কররানী বংশের শাসনকাল : কররানী বংশের শাসকদের শাসনকাল নিচে আলোচনা করা হলো :
(ক) তাজ খান কররানীর শাসন : তাজ খান ছিলেন একজন সুযোগ্য শাসক। তার সময়ে সর্বপ্রথম রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। তিনি পূর্ব ভারতের সীমান্ত হতে উড়িষ্যা এবং শোন নদী হতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত কররানী বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি হাজীপুরের কোকারদের বিদ্রোহও কঠোর হস্তে দমন করেন। 'তবে এক বছরের মধ্যেই তিনি মারা যান।
(খ) সোলায়মান কররানীর শাসন : ভাজ খানের মৃত্যুর পর তার ভাই সোলায়মান কররানী বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সময় কররানী বাংলায় একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়।
১. শক্তিশালী সেনাবাহিনী : সোলায়মান কররানী ছিলেন একজন সুযোগ্য শাসক ও সুদক্ষ বিজেতা। তার সময়ে অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক আফগান বাংলায় এসে তার আশ্রয় গ্রহণ করলে তিনি তাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন।
ঐতিহাসিক জন স্টুয়ার্ট -এর মতে, “সোলায়মানের অধীনে ৩৮শ হাতি, ৪০শ অশ্বারোহী সৈন্য, ১৪ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ২শ কামান ছিল।"
২. মুঘলদের সাথে মিত্রতা স্থাপন : তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ। ড. আব্দুল করিম বলেন, "মুঘলদের সাথে এমন ব্যবহার করেন যাতে মুঘলরা তার বিরুদ্ধে না দাঁড়ায়।
" যদিও তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলার সার্বভৌম শাসক ছিলেন তথাপি মুঘল সম্রাট হুমায়ূন ও আকবরের নিকট উপহারসামগ্রী প্রেরণ করেন। তিনি সুলতান উপাধিও গ্রহণ করেননি।
এমনকি তিনি আকবরের নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করেন। তাই ড. করিম যথার্থই বলেন, -“এভাবে তিনি মুঘলদের সম্প্রসারণ নীতি হতে বাংলা-বিহারকে মুক্ত রাখেন।”
৩. উড়িষ্যা বিজয় : মুঘলমান সুলতানদের মধ্যে একমাত্র সোলায়মান কররানীই উড়িষ্যা জয় করতে সমর্থ হন। উড়িষ্যার রাজে মুকুন্দ হরিচন্দন পলাতক ইব্রাহিম খান শূরকে আশ্রয় দিলে সোলায়মান তার পুত্র বায়েজিদ ও সেনাপতি কালাপাহাড়কে উড়িষ্যা বিজয়ে প্রেরণ করেন।
তারা ১৫৬৭ সালে পুরীসহ সমগ্র উড়িষ্যা অধিকার করেন। উড়িশ্যা বিজয় সম্পন্ন করে সোলায়মান শুধু নিজের | মর্যাদাই বৃদ্ধি করেননি। বরং অফুরন্ত ধন রত্নও লাভ করেন।
৪. কুচবিহারের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন : ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কুচবিহার রাজ্যের নরনারায়ণ ও তার ভ্রাতা শুকলাধ্বজা বাংলা আক্রমণ করে। সোলায়মানের সাথে যুদ্ধে কুচবিহারের রাজা পরাজিত হন।
মুঘলমানগণ ব্রহ্মপুত্র হতে তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করেন এবং কামাখ্যা, হালো ও অন্যান্য স্থানের মন্দিরগুলো বিধ্বস্ত করে।
তবে ইতোমধ্যে বাংলায় মুঘল আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি কুচবিহারের রাজার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন।
৫. সোলায়মানের কৃতিত্ব : তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী শাসক। তিনিই সর্বপ্রথম গৌড় হতে তাণ্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করেন।
তার শাসনব্যবস্থায় ইসলামি বিধিবিধান কঠোরভাবে অনুসৃত হতো। পরবেশ ও পণ্ডিতগণ তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তিনি মালদহের সোনা মসজিদও নির্মাণ করেন। ১৫৭২ সালে তিনি মারা যান।
(গ) বায়েজিদ কররানীর শাসন : সোলায়মান কররানীর মৃত্যুর পর পুত্র বায়েজিদ কররানী বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তার অত্যাচারে অল্পদিনের মধ্যেই জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং অমাত্যবর্গ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
সোলায়মানের জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র হানসু বায়েজিদকে হত্যা করে। অতঃপর আমীরদের সহায়তার সোলায়মানের কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ খান বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
(ঘ) দাউদ কররানীর শাসন : বায়েজিদ কররানীর মৃত্যুর পর ভ্রাতা দাউদ কররানী ১৫৭২ সালে বঙ্গের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন কররানী বংশের শেষ স্বাধীন নরপতি।
তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করলে আকবর সেনাপতি মুনিম খানকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।
দাউদ সেনাপতি লোদী খান ও গুজার খানের সাহায্যে মুনিম খানকে মূল্যবান উপহার পাঠিয়ে এবং আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে প্রাথমিক মুঘল অভিযান প্রতিহত করেন।
১. আকবরের সাথে যুদ্ধ : পরে ১৫৭৩ সালে আকবর মুনিম খানের সাহায্যে টোডরমলকে প্রেরণ করেন। দাউদ খান উজির লোদী খান, কতলু লোহানী, গুজার খান এবং শ্রীহরির সাথে একত্রিত হয়ে মুঘল বাহিনীকে প্রতিহত করেন।
অতঃপর মুনিম খান এক বিশাল বাহিনী নিয়ে দাউদ খানকে আক্রমণ করে। ১৫৭৪ সালে আকবর সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে হাজীপুর অধিকার করেন। দাউদ ভয়ে তান্ডায় পলায়ন করলে আকবর পাটনা অধিকার করেন।
পরে মুঘল বাহিনী তান্ডা অধিকার করে। ১৫৭৫ সালে দাউদ আকবরের বাহিনীর সাথে তুকারই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুঘল বাহিনীর সাথে সন্ধি স্থাপন করেন।
২. রাজমহলের যুদ্ধ : ইতোমধ্যে দাউদ খান মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের মৃত্যুতে মুঘল আধিপত্য অস্বীকার করে তান্ডা দখল করেন।
অতঃপর ১৫৭৫ সালে আকবর খান জাহানকে সেনাপতি নিযুক্ত করে বাংলা অভিযানে প্রেরণ করেন। দাউদ খান মুঘল বাহিনীর সাথে ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে অংশ নেয়।
যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত হন এবং চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে তাকে হত্যা করা হয় । ফলে বাংলার আফগান স্বাধীন সালতানাত সমাপ্ত হয়।
উপসংহার : দাউদ খানের পতনের সাথে সাথে আফগানদের সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটে। এর ফলে বাংলার স্বাধীন সত্তা বিলুপ্ত হয়।
বাং।য়ে এই কররানী বংশের শাসনামলে বাংলা একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল। এ বংশের পতনের সাথে বাংলা মুঘল শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়।