অতীশ দীপঙ্কর কে ছিলেন । অতীশ দীপঙ্করের পরিচয় সংক্ষেপে তুলে ধর
অতীশ দীপঙ্কর কে ছিলেন । অতীশ দীপঙ্করের পরিচয় সংক্ষেপে তুলে ধর |
অতীশ দীপঙ্কর কে ছিলেন । অতীশ দীপঙ্করের পরিচয় সংক্ষেপে তুলে ধর
- অথবা, অতীশ দীপঙ্করের জীবনী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
- অথবা, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান কে ছিলেন?
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার মাটিতে পালবংশের রাজত্বকালে একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত ও সাধকের আগমন ঘটেছিল তিনি হলেন অতীশ দীপঙ্কর।
তিনি একাধারে ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রসারের জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন এবং কঠোর সাধনায় ব্রত হন।
তার জ্ঞান গবেষণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার রচিত অসংখ্য পুস্তকে। তার প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে।
→ অতীশ দীপঙ্করের পরিচয় : নিম্নে সংক্ষেপে অতীশ দীপঙ্করের পরিচয় তুলে ধরা হলো :
১. জন্ম : অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কল্যাণশ্রী ও মাতা প্রভাবতী দেবী রাজ পরিবারের সদস্য ছিলেন।
তার বাল্য নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। তিনি পিতামাতার মধ্যম সন্তান ছিলেন। তার বাসস্থান বজ্রযোগিনী গ্রাম এখনও রয়েছে। তবে এখন আর তেমন ঐতিহ্য নেই। এখন তার বাসস্থান নাস্তিক পণ্ডিতের বাড়ি নামে পরিচিত।
২. বাল্যকাল : ছোটবেলায় তার নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিবাহ করেন।
কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায় ।
৩. শিক্ষা জীবন : অতিশ দীপঙ্কর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে মায়ের কাছে। তিনি তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষা পড়তে শেখেন ও ১০ বছর বয়সে বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন।
তিনি বিখ্যাত বৌদ্ধগুরু জেতারির নিকট বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রে শিক্ষালাভ করেন এবং জেতারির পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তীতে নালন্দার শাশিক্ষা করতে যান।
১২ বছর বয়সে নালন্দায় আচার্য বোধিতন্ত্র তাকে শ্রমণরূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তার নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
১২ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বোধি ভদ্রের গুরুদের অবধৃতিপাদের নিকট সর্বশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
১৮-২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিক্রমশীলা বিহারের উত্তরদ্বারের দার পণ্ডিত মাতপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা করেন।
তিনি ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে শতাধিক শিষ্যসহ মালয় দেশের সুবর্ণদীপ (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা) গমন করেন এবং আচার্য ধর্মপালের কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধদর্শন শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে স্বদেশে ফিরে আসার পর তিনি বিক্রমশীলা বিহারে অধ্যাপনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
৪. বৌদ্ধধর্মের প্রচার : ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দে দীপঙ্কর তিব্বত যাত্রার জন্য প্রয়াত হন এবং মাঝপথে নেপালে একবছর সময় অতিবাহিত করেন।
এরপর নেপাল অতিক্রম করে তিনি তিব্বতে পৌছান। দীপঙ্কর তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন।
তিনি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করে বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার করেন। বোধিপথ প্রদীপ রচনাকে ভিত্তি করে তিব্বতে একটি নতুন ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়।
৫. অতীশ দীপঙ্করের রচনাবলি : অতীশ দীপঙ্কর দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, সম্পাদনা ও অনুবাদ করেছেন। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ ভাঙ্গুর নামে বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেন।
বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা বিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে তিব্বতী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতীরা তাকে অতীশ উপাধিতে ভূষিত করেন।
অতীশ দীপঙ্কর অনেক সংস্কৃত এবং পালি বই তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করেন। দীপঙ্করের রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে বোধিপথ প্রদীপ, চর্যাসংগ্রহ প্রদীপ, মধ্যোমপদেশ, সংগ্রহগর্ভ ইত্যাদিসহ আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে।
বিখ্যাত পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও ইতালির বিখ্যাত গবেষক গুসেফ তুমি তার অনেকগুলো বই আবিষ্কার করেন।
তার পাণ্ডিত্য ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় অভিভূত হয়ে বাংলাদেশের পালরাজা মহীপাল তাকে বিক্রমশীলা (ভাগলপুর ও বিহার) মহাবিহারের আচার্যপদে নিযুক্ত করেন।
৬. মৃত্যু : বৌদ্ধধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরের নিকটস্থ লেখান পল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার সমাধিস্থল লেখানে তিব্বতীদের তীর্থ- কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, অতীশ দীপঙ্কর বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সাধক ছিলেন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত তার ধর্মের প্রসার ও প্রচারে যে পরিশ্রম করেছেন তা তাকে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
তিনি জ্ঞানচর্যায় ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। তার নামানুসারে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলার একজন প্রতিভাবনে ব্যক্তি হিসেবে তিনি এদেশের মানুষের মনোস্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।