আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়ে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের বিবরণ দাও
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়ে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের বিবরণ দাও |
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়ে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের বিবরণ দাও
- অথবা, আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়ে সাহিত্যের অগ্রগতিতে কারা ভূমিকা রেখেছিল? বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনকালে শিল্প- সাহিত্য চরম উৎকণ্ঠা লাভ করেছিল। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ তার শাসনকালে শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
তিনি বাংলা সাহিত্যকে তার শাসন ব্যবস্থায় একটি অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেন। এসময়কার বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি নবযুগের আবির্ভাব ঘটে।
এ কারণে বলা হয়- ‘During the reign of Husain Shah Bengali literature reached to its best time' অর্থা হুসেন শাহের শাসনকালে বাংলা সাহিত্য শ্রেষ্ঠ সময়ে উপনীত হয়েছিল।
হুসেন শাহের সময়ে কবি-সাহিত্যিক : হুসেন শাহের সময়ে বিখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিকদের দেখা মেলে। এসকল কবি সাহিত্যিক শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যই নয়, অন্যান্য ভাষার সাহিত্যেও রচনা করেছিল। নিম্নে হুসেন শাহের সময়ে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের বর্ণনা দেয়া হলো।
১. বিজয়গুপ্ত : সুলতান হুসেন শাহের সময়ে "বিজয়গুপ্ত' 'মানসম্পন্ন' কাব্য রচনা করেন। তিনি 'পদ্মপুরান' নামও একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
তবে 'মনসামঙ্গল' গ্রন্থটি রচনা করবার জন্য তিনি বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন। মনসামঙ্গলে তিনি চাঁদ সওদাগর ও দেবী মনসার মধ্যে সংগঠিত দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন।
এ গ্রন্থটি অন্যতম দুটি চরিত্র হলো বেহুলা ও নদীবন্দর। এ গ্রন্থে বিজয় গুপ্ত হুসেন শাহের গুণাগুণ করেছেন।
২. মালাধর বসু : সুলতানি আমলের একজন বিখ্যাত কবি হলেন মালাধর বসু। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কুলীনগ্রামে এক কায়স্থ বংশে তার জন্ম।
তিনি ছিলেন গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের মন্ত্রী এবং তারই সহায়তায় রূপ গোস্বামী ও সনাতন উত্ত রাজসভায় নিয়োগ লাভ করেন। তার একমাত্র কাব্য শ্রীকৃষ্ণ বিজয়'।
কবিত্বগুণের সম্মাননাস্বরূপ মালাধর বসু গৌড়েশ্বরের কাছ থেকে 'গুণরাজ খান' উপাধি লাভ করেন। 'শ্রী কৃষ্ণ বিজয়' গ্রন্থে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও মহিমা কীর্তন করা হয়েছে।
৩. রূপগোস্বামী : রূপগোস্বামী গৌড়ের নিকটবর্তী রামকেলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃদত্ত নাম সন্তোষ। কিন্তু চৈতন্যদের প্রদত্ত রূপনামেই তিনি বেশি প্রসিদ্ধ। রূপ হুসেন শাহের দরবারে চাকরি করতেন।
তিনি ছিলেন হুসেন শাহের দবির খাস বা প্রধান সচিব। তিনি কয়েকটি মূল্যবান বৈষ্ণব গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- হংসদূত, বিনন্ধ মাধব ললিত মাধব, উপদেশামৃত প্রভৃতি ।
৪. সনাতন গোস্বামী : সনাতন ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রের সুপণ্ডিত। ইনি রূপ গোস্বামীর অগ্রজ। তার গার্হস্থ্য জীবনের নাম অমর। তিনি সুলতান হুসেন শাহের রাজদরবারে রাজস্ব মন্ত্রী ছিলেন।
তাই আরবি ও ফারসি ভাষায়ও তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি শ্রীমন্তাভাতের টীকা রচনা করেন। 'নীলা বাস্তব' ও 'হরি ভক্তিবিলাস'-ও তার রচিত গ্রন্থ।
৫. বিপ্রদাস : বিপ্রদাস হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তিনি হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় 'মনসা বিজয়' ও 'মনসামঙ্গল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এ দুটি গ্রন্থ তার কবিত্বের পরিচয় বহন করে। দেবী মনসার কাহিনিকে কেন্দ্র করে এ সকল কাব্যের কাহিনি রচিত হয়েছে।
৬. যশোরাজ খান : বৈষ্ণব পদকার যশোরাজ খানকে হুসে শাহ সম্ভবত উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি হুসেন শাহের একজন রাজ কর্মচারী ছিলেন। চৈতন্য পরবর্তী যুগের পদকর্তাদের মধ্যে যশোরাজ খাঁ অন্যতম।
যশোরাজ খান 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' রচনা করেছিলেন। তিনি হুসেন শাহকে প্রশংসা করেছেন এভাবে- "শ্ৰীযুত হুসন জগত ভূষণ সেহ ইহ রস জান। পঞ্চ গৌড়েশ্বর ভোগ পুরন্দর ভনে যশোরাজ খান "
৭. िজনার্দন : জি জনার্দন হুসেন শাহের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। তিনি হুসেন শাহের অনুপ্রেরণায় 'চন্ডীর উপাদান' রচনা করেছিলেন।
এ উপাখ্যান বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিল জনার্দন তার রচনায় নিজের মেধার পরিচয় দিয়েছেন।
৮. কবি কংক : কবি কংক মধ্যযুগের একজন কবি ও সত্যপীরের পাঁচালি কাব্যের আদি রচয়িতা। তিনি চৈতন্যদেরে সমসাময়িক ছিলেন। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বিপ্রগ্রাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ছয়মাস বয়সে তিনি পিতৃমাতৃহীন হয়ে এক চণ্ডাল সম্পত্তির ঘরে লালিত পালিত হন। বাল্যকাল থেকে কংকের মধ্যে কবি প্রতিভার প্রকাশ ঘটে।
তিনি চমৎকার বাঁশি বাজাতেন এবং মুখে মুখে শ্লোক রচনা করতেন। তিনি আকস্মিকভাবে এক মুসলিম ফকিরের সংস্পর্শে আসেন এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
এ ফকিরের আদেশেই তিনি সত্যপীরের প্যাচালী রচনা করে। কবি কংক নামে পরিচিত হন। তার সত্যপীরের পাঁচালি বাংলার সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
৯. শ্রীকর নন্দী : শ্রীকরনদী হুসেন শাহের প্রতিনিধি এবং চট্টগ্রামের শাসন পরাগন খানের পুত্র ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। শ্রীকরনন্দী মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের বাংলা অনুবাদ করেন।
মহাভারতের এ পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মহাভারতের কাহিনি এই অংশের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। পাণ্ডবদের ক্ষমতায় আরোহণের উপর নির্ভর করে এ কাহিনি রচিত হয়েছে।
১০. কবীন্দ্র পরমেশ্বর : মধ্যযুগের খ্যাতনামা কবি এবং বাংলা ভাষায় প্রথম মহাভারত রচয়িতা হিসেবে কবীন্দ্র পরমেশ্বরের নাম সর্বজন-বিদিত। তাঁর পিতৃদত্ত নাম পরমেশ্বর দাস। 'কবীন্দ্র' তার সম্মানসূচক উপাধি।
তিনি হুগলির সপ্তগ্রাম অঞ্চলের বলেন্ডায় জন্মগ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কর্তৃক পরাগন খানের সভাকবি নির্বাচিত হয়ে তিনি চট্টগ্রামে আগমন করেন এবং বাকি জীবন সেখানেই অতিবাহিত করেন।
পরাপন খান সংস্কৃত মহাভারতের কাহিনি লোকমুখে শুনে কৌতূকী হন এবং কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে সংক্ষিপ্ত আকারে বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করার নির্দেশ দেন। তার রচিত মহাভারত 'কবীন্দ্র মহাভারত' বা পরাবানী মহাভারত নামে পরিচিত।
১১. মুহম্মদ বুদই : মুহম্মদ বুদই হুসেন শাহকে তার গ্রন্থ উৎসর্গ করেন। তার রচিত গ্রন্থের নাম 'হিদায়াতুল রামী'। এ গ্রন্থটি ধনুর্বিদ্যা সংক্রান্ত সে যুগে যুদ্ধ বিগ্রহে অস্ত্রশস্ত্র হিসেবে তীরের ব্যবহার হতো। ফলে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় রচিত।
১২. মুহম্মদ-বিন-ইয়াজদান বক্স : মুহাম্মদ-বিন-ইয়াজদান বক্স ১৫০৩ খ্রিষ্টাব্দে 'সহীহ-আল-বুখারী' গ্রন্থের তিন খণ্ডে অনুবাদ সমাপ্ত করেন।
গ্রন্থখানি হুসেন শাহের রাজধানী একডালায় বসে লিখিত। তৃতীয় খণ্ডের পুথির ওপকার হুসেন শাহের এক দীর্ঘ প্রশস্তি রয়েছে। ইনিও একজন ফারসি ভাষার পণ্ডিত।
১৩. কুতবন : কুতবন একজন আরবি ভাষার কবি। তিনি হুসেন শাহ শার্কীর সাথে বাংলায় আসেন। ১৫১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘মৃগাবর্তী' নামক গ্রন্থ রচনা করেন। হুসেন শাহ সম্পর্কে তিনি বিশেষ গুণকীর্তন করেছেন।
তিনি হুসেন শাহ সম্পর্কে বলেন— “যিনি ধর্মে যুধিষ্ঠর, দানে কর্নের সমকক্ষ ছিলেন, তিনি কুতবনের মত মোহাজেরকে আশ্রয় ও সাহায্য দান করবেন এটা স্বাভাবিক ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, হুসেন শাহের সময়ে বাংলায় প্রচুর কবি-সাহিত্যিকদের সমাগম ঘটেছিল। এ সময়ে শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় নয়, বরং আরবি, ফারসি ভাষায়ও কাব্য চর্চা হয়েছিল।
এসকল ঘটনা থেকে হুসেন শাহ যে একজন সাহিত্যপ্রেমী ব্যক্তি ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হুসেন শাহের একান্ত প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা চলে ।