তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের পটভূমি আলোচনা কর
তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের পটভূমি আলোচনা কর |
তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের পটভূমি আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে এক অন্যতম গুরুত্ব বহন করে। এটা ছিল ভারতের ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
এক যুদ্ধে এতো বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে যে কথিত আছে মহারাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ঘরে স্বজন বিয়োগের ছায়া পড়েছিল এ যুদ্ধের ফলে।
বার বার পানিপথের প্রাস্তরে ভারতের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। আর পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় মারাঠা এবং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে আফগান মুসলিমদের মধ্যে। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতে মারাঠা শক্তি ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়ে।
→ পানিপথের যুদ্ধের পটভূমি :
১. আহমদ শাহ আবদালীর পুনঃআগমন : ভারতবর্ষে মারাঠারা ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের বহু এলাকা নিজেদের দখলে নেয় বিশেষ করে উত্তর ভারতের বহু স্থান মারাঠাদের দখলে আসে।
ফলে আহমদ শাহ আবদালী আবার ভারতে আসার পরিকল্পনা করেন। তিনি অযোধ্যার নবাব এবং রোহিলা খণ্ডের নবাব সুজাউদ্দৌলার সাথে চুক্তি করেন। এ তিন শক্তির মিলিতরূপে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
২. মারাঠাদের শক্তি বৃদ্ধি : ভারতে মারাঠারা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠে। তারা মুঘলদের নিকট হতে বহু এলাকা দখল করে নেয়। ফলে মারাঠাদের শক্তি বৃদ্ধিতে রোহিলা খণ্ডের নবাব সুজাউদ্দৌলা ভীত হয়ে আবদালীকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ফলে আবদালী ভারতে আক্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠে।|
৩. বালাজী বাজীরাওয়ের অদূরদর্শিতা : হাজীরাওয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে রাজপুত্ররা রেগে ছিল। তাছাড়া পাঞ্জাবের শিখদেরকে নিজ দলে টেনে নেয়ার মতো সুবিবেচনা তার মধ্যে ছিল না।
আর বাজীরাওয়ের এসব অদূরদর্শিতার কারণে আবদালী তাদের আক্রমণে সাহস পায় ফলে যুদ্ধ অনিবার্য রূপ নেয়।
৪. প্রাথমিকভাবে আবদালীকে প্রতিরোধে ব্যর্থতা : আবদালীর ভারত আক্রমণের প্রথম দিকে দিল্লির দশ মাইল দূরে দত্তালী সিন্ধিয়া প্রাণ হারান মার্চ মাসে মলহার বাও হোলকার পরাজিত হন আফগান যোদ্ধাদের নিকট।
এছাড়া হায়দারাবাদের | নিজামকে হারানো সদাবিশ রাও ভাও পরাজয়বরণ করে নিতে বাধ্য হন। এসব প্রাথমিক আক্রমণে সাফল্য আবদালীকে মারাঠাদের বিরুদ্ধে আক্রমণে উৎসাহী করে।
৫. অবস্থান : পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় পানিপথ নামক স্থানে। যা ছিল দিল্লি থেকে ৮০ মাইল দূরে সানউদি বোডের পাশে। আর এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় মারাঠা বাহিনী এবং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে আফগান বাহিনীর মধ্যে।
যুদ্ধের ঘটনা : ১৭৬১ সালের ১৪ জানুয়ারি পানিপথ নামক স্থানে আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে প্রায় ৬০,০০০ হাজার প্রশিক্ষিত আফগান সেনা এবং মারাঠাদের পক্ষে ছিল ৪৫,০০০ হাজার সেনা।
প্রথমে মনে করা হয়েছিল মারাঠারা জিতবে। কিন্তু আবদালীর কৌশলে মারাঠারা পেরে উঠতে পারেনি। মারাঠা বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী এবং অন্যান্য মিত্ররা।
এদিকে মারাঠা বাহিনীর রসদ আসার পথ বন্ধ করেছিল ফলে তারা আরও বেশি বিপদে পড়ে। প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয় ১৭৬১ সালে ১৪ জানুয়ারি সকাল ৮টায়।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে মারাঠারা যখন ক্লান্ত তখন আহমদ শাহ আবদালী হঠাৎ ১৩,০০০ সৈন্য নামিয়ে | যুদ্ধের চেহারা পাল্টে দেন।
হঠাৎ আক্রমণে মারাঠারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। সেদিন শেষ বিকালে মারাঠা বাহিনী যেন কর্পূরের মতো উঠে [ গিয়েছিল। এ দুঃসংবাদ শুনে পেশোয়ার কয়েক মাস পরেই মারা যায়।
যুদ্ধের ফলাফল :
১. হতাহত : ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ। এতে উভয়পক্ষে বহু সৈন্য হতাহত হয়। যুদ্ধের পরের দিন ঠাণ্ডা মাথায় আবদালী প্রায় ৮০,০০০ হাজার বন্দি হত্যা করেন।
আর আহত হয়েছিল বহু, যদিও নিহতের সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। তবে কেউ কেউ বলেন এ সংখ্যাটা ৬০,০০০ থেকে ৭০,০০০ হাজারের মতো হবে।
২. মারাঠা ইতিহাসের ধারা পরিবর্তন : এ যুদ্ধের আগে মারাঠারা বহু জায়গা দখল করে ভারতে নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের ফলে নিমেষেই তাদের গৌরব- প্রতিপত্তি হারিয়ে যায়।
যুদ্ধে বহু হতাহত এবং অর্থের অপচয় ছাড়াও তারা ভারতবর্ষে তাদের অবস্থান হারায়। পাঞ্জাবের শিখরা মারাঠাদের উপর থেকে তাদের ভরসা তুলে নেয়।
৩. ইংরেজ শক্তির বিস্তার : মারাঠা মুসলিম দ্বন্দ্বের সুযোগে ইংরেজরা শুধুমাত্র বণিক ছদ্মবেশে দেশকে যে গিলে খাচ্ছে এটা কেউ দেখেও দেখেনি। তাদের কোনোরূপ বাধাও দেয়নি।
ফলে বাধাহীনভাবে ধীরে ধীরে ইংরেজরা এদেশে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে তারা ভারতবর্ষে অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয় । যা পরবর্তীতে তাদের ভারত জয়ে আগ্রহী করে তোলে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ইতিহাসে এক যুগান্তকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মারাঠারা আহমদ শাহ আবদালীর নিকট চরমভাবে পরাজিত হয়।
যুদ্ধে মারাঠা বাহিনীর শক্তি ভেঙে পড়ে। আর্থিকভাবেও তারা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলত মারাঠারা এ যুদ্ধে আহমদ শাহ আবদালীর পরিকল্পনার কাছে হেরে যায়।
কারণ আবদালী মারাঠাদের চারপাশের মুসলিম শাসকদের সাথে চুক্তি করে নিজের দলে নিয়ে আসে যেটা মারাঠারা পারেনি। ফলে চতুর্দিকের আক্রমণ সামলানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তারা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে।