সুলতান প্রথম বাইবার্সের প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ আলোচনা কর
সুলতান প্রথম বাইবার্সের প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ আলোচনা কর |
সুলতান প্রথম বাইবার্সের প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, সুলতান প্রথম বাইবার্সের প্রশাসনিক সংস্কার সমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : আইয়ুবী শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে আইয়ুবী বংশের পতন ঘটিয়ে এক তুর্কি ক্রীতদাসী শাজার-উদ-দার ১২৫০ সালে মিশরে মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই রাজবংশ যার শাসনামলে খ্যাতির শীর্ষচূড়ায় উপনীত হয়েছিল তিনি ছিলেন সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স।
সিংহাসনে আরোহণের পর বার্বারদের অপতৎপরতা, শিয়াদের ষড়যন্ত্র, গুপ্তঘাতকদের অন্ত ঘাতমূলক তৎপরতা, মোঙ্গলদের আক্রমণের আশঙ্কা, খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের আক্রমণ ইত্যাদি থেকে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রতিহত করে তিনি সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করেন। তার শাসনামলের প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ।
- সুলতান প্রথম বাইবার্সের প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ : প্রথম বাইবার্সের প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে তার পরিচয় সম্পর্কে জানা আবশ্যক।
১. বাইবার্সের প্রাথমিক জীবন : সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ১২২০ সালে কিপচাক তুর্কি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বালাজীবন কাটে দাস হিসেবে সিরিয়ায় ও দামেস্কে।
১৯৪৬ সালে আইয়ুবী সুলতান আস সালিহ ডাকে এক ব্যবসায়ী থেকে উচ্চমূল্যে ক্রয় করে নিজ দেহরক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ করেন। পরে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ যোগ্যতাবলে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
২. সিংহাসনে আরোহণ : ১২৫০ সালে আইয়ুবী সুলতান আল সালিহের মৃত্যুর পর মিশরের শাসন ক্ষমতা নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সাজার-উদ-দার আইবেক, খলিল এবং সর্বশেষ সাইফুদ্দীন কুতুজ মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন।
ফলে এই অস্থিতিশীলতার সুযোগে ১২৬০ সালে মোঙ্গলরা রাজ্যে আক্রমণ করলে বাইবার্স আইন-ই-জালুতের যুদ্ধে তাদের পরাজিত করে। এরপর অযোগ্য কুভুজকে হত্যা করে ১২৬০ সালে বাইবার্স সিংহাসনে বসেন।
৩. আব্বাসীয় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা : ১২৫৮ সালে হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের ফলে আব্বাসীয় খিলাফতের অবসান ঘটে। রুকনউদ্দিন ১২৬০ সালে মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি ১২৬১ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।
৪. সৈন্যবাহিনীর পুনর্গঠন : সুলতান বাইবার্স পুনঃপুন মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ এবং ক্রুসেডারদের দমন করার জন্য জল ও স্থল বাহিনীর পুনর্গঠন করেন।
তিনি রোমান প্রিটারিয়ান গার্ড এবং আব্বাসীয় ও তুর্কি বাহিনীর ন্যায় রেজিমেন্টের ভিত্তিক মামলুক বাহিনীকে সুবিন্যস্ত করেন।
৫. জায়গির প্রথার বিলোপ : বাইবার্স পূর্বের জায়গির প্রথা বাতিল করে সেনাবাহিনীকে কেন্দ্রের অধীনে নিয়ে আসেন এবং নিয়মিত নগদ বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
৬. ডাক ও বিচার বিভাগের সংস্কার : বিচার বিভাগের সংস্কার করে তিনি কায়রো দুর্গের পদমূলে একটি বিচারালয় পুনঃনির্মাণের নির্দেশ দেন। তাছাড়া মিশরের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র শাসক যিনি ইসলামের চার মাজহাবের জন্য ৪ জন আলাদা ইমাম নিয়োগ দেন।
ডাক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি কায়রো ও দামেস্কের মধ্যে ডাকের প্রচলন করেন। এ সময় একটি পত্র কায়রো থেকে দামেস্ক যেতে মাত্র ৬০ ঘণ্টা সময় লাগত।
৭. রাজস্ব সংস্কার ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ : সুলতান রাজস্ব সংস্কার করে পুরাতন ও অযৌক্তিক অনেকগুলো কর বাতিল করে দেন। তাছাড়া সমস্ত রাজ্যজুড়ে দ্রব্যমূল্যের একটি তালিকাও তৈরি করে দেন।
রাজস্ব আদায়ে যাতে বাড়াবাড়ি না করা হয় সে নির্দেশ দেন। ফলে ১২৬৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল।
৮. গোয়েন্দা বাহিনী গঠন : সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ছিলেন একজন সুচতুর শাসক। তাই রাজ্যে তাঁর বিরোধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও জনগণের অভাব অভিযোগ জানার জন্য একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনী সুলতানের নিকট সঠিক তথ্য সরবরাহ করতো।
৯. কৃষিশিল্প ও বাণিজ্য : সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ছিলেন একজন জনহৈতিষী শাসক। তাঁর রাজ্যের কৃষি-ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি বহু নতুন খাল খনন ও পুরাতন খাল সংস্কার করেন। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি বিধানের জন্য তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থাদি সহজ করে দেন।
১০. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক : সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স নিজে নিরক্ষর হলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে তিনি একনিষ্ঠভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে যান।
তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে সাম্রাজ্যে অসংখ্য স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। জন্যধ্যে প্রসিদ্ধ হলো জাহিরিয়া মাদ্রাসা।
১১. স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক : সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স শিক্ষার পাশাপাশি স্থাপত্য শিল্পেরও একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
তিনি কায়রোর প্রধান মসজিদটিতে ১২৬৯ সালে একটি অপূর্ব সুন্দর গুপ্ত নির্মাণ করেন। এছাড়া ময়দান আল খায়বারে তিনি ঐতিহাসিক কাসর আরলাফ প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
১২. গুপ্তঘাতকদের দমন : সিরিয়ার অভ্যন্তরে মারকাব এবং হামাব মধ্যবর্তী আল মারিয়া পার্বত্য অঞ্চলে ইসমাইলীয় গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের ৯টি দুর্গ ছিল।
১২৭০-১২৭৩ সালের মধ্যে বাইবার্স অভিযান চালিয়ে গুপ্তঘাতকদের শক্তিশালী কানমুস কালিফা, খাওয়াইবী, মানিকা, মাসিয়াফ, উন্নাইকা প্রভৃতি দুর্গসমূহ দখল করেন।
১৩. ক্রুসেডারদের দমন : সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ১২৬৩-৭১ সালের মধ্যে অভিযান চালিয়ে ক্রুসেডারদের হাত থেকে জাফা, অ্যান্টিয়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ হহৃত অঞ্চলগুলো পুনরায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
১৪. কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন : মামলুক সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স তার প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে মোঙ্গল ও ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপন করেন।
তিনি কিপচাকের মোঙ্গলদের সালে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। এরপর দ্রুত বিনিময়ের মাধ্যমে গোল্ডেন হোর্ড মোঙ্গল নেতা আল বারাকার সাথেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
কনস্টান্টিনোপল সম্রাট পগালঊলোগাস, এশিয়া মাইনরের রাজা খসরু এবং সিংহলের শাসকের সাথেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মিশরের মামলুক বংশের ইতিহাস পঠন-পাঠনে যে শাসকের নাম বেশি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়। তিনি হচ্ছে সম্রাট রুকনউদ্দিন বাইবার্স।
তিনি শিশু মামলুক সাম্রাজ্যকে পরিপূর্ণতা দানের জন্য সর্বপ্রথম নজর দেন প্রশাসনিক সংস্কারের দিকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রশাসনিক সংস্কার করা ছাড়া মামলুক বংশকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ১২৬০ সালে সিংহাসনে আরোহণের পর মোঙ্গল ও ক্রুসেড হামলা প্রতিরোধ, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, কৃষি-শিল্প ও ব্যবসা- বাণিজ্যের উন্নতি বিধানের মাধ্যমে তিনি মামলুক সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা লাভ করেন ।