সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে উজির নিজামুল মুলকের অবদান কী ছিল
সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে উজির নিজামুল মুলকের অবদান কী ছিল |
সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে উজির নিজামুল মুলকের অবদান কী ছিল
- অথবা, নিজামুল মূলকের অবদানসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : যে কয়জন মহৎ ব্যক্তি কোন রাজবংশে জন্মগ্রহণ না করেও স্বীয় কর্মক্ষমতা যারা ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন তার মধ্যে নিজামুল মূলক উল্লেখযোগ্য।
সেলজুক সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে প্রধান উজির নিজামুল মুলকের অবদান অপরিসীম। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দরুনই মালিক শাহের রাজত্বকালে তিনি ইতিহাসে মহিমান্বিত ও স্থায়ী হয়ে আছেন।
হাদীস ও ফিকাহশাস্ত্র নিজামুল মুলকের ব্যাপক পাণ্ডিত্য ছিল। নিজামুল মুলকের বিচক্ষণতার জন্য মালিক শাহ সিংহাসন অধিকার করতে পেরেছিলেন।
ঐতিহাসিক পি.কে হিটি তাকে ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম অলংকার বলে অভিহিত করেন।
নিজামুল মুলকের কার্যাবলি নিম্নে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :
১. নিজামুল মুলকের পরিচয় : নিজামুল মুলকের আসল নাম খাজা আৰু আলী আল হাসান। তিনি ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলী।
নিজামুল মূলক প্রথম চাকরি জীবন শুরু হয় সুলতান মাহমুদের শাসনামলে এবং গঙ্গনীদের পতন ঘটলে তিনি সেলজুকদের অধীনে চাকরি করতেন।
তার বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন দেখে অনেক ঐতিহাসিক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ১০৯২ সালে তিনি মারা যান।
২. উপাধি গ্রহণ : মালিক শাহের ২০ বছরে রাজত্বকালে নিজামুল মুলক স্বীয় হস্তে সকল ক্ষমতা এরূপে কেন্দ্রীভূত করেন যে, সুলতানের সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকা অথবা মৃগরার যাওয়া ব্যতীত কোন কাজ ছিল না।
নিজামুল মুলকের একনিষ্ঠ সেবা, অসাধারণ ত্যাগ, বিচক্ষণতা এবং জনমঙ্গলের শাসনকল্পে সুলতান মালিক শাহ তাকে আতাবেগ উপাধিতে ভূষিত করেন।
৩. প্রধান উজিরের পদ অলংকরণ : ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে ভূমিল বেগ সুনিপুণ কৌশলে সুলতান মাহমুদকে পরাজিত করে গৌড় রাজ্য অধিকার করেন । তিনি নিজামুল মুলককে স্বীয় খতিব নিযুক্ত করেন।
অতঃপর ভূমিল বেগের মৃত্যুর পর তার পুত্র আলপ আরসালানের আমলে নিজামুল মুলক প্রধানমন্ত্রী/উজির পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় তিনি বিখ্যাত উপাধি নিজামুল মুলক উপাধি প্রাপ্ত হন।
৪. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ : আলপ আরসালানের মৃত্যুর পর তদীয়পুত্র মালিক শাহ সেলজুক সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময় থেকে নিজামুল মুলকের গৌরবময় জীবন শুরু হয়।
তিনি বাহ্যিকভাবে প্রধানমন্ত্রী থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। ঐতিহাসিক ইবনে মলিকের মতে, মালিক শাহের বিশ বছরের রাজত্বকালে নিজামুল মুলক নিজ হস্তে এমনভাবে ক্ষমতা হস্তগত করেন যে, সুলতানের সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকা ছাড়া অন্য কোন কাজ ছিল না।
৫. বিদ্রোহ দমন ও শাসন সংস্কার : সুলতান মালিক শাহের রাজত্বকাল সম্প্রসারণ অপেক্ষা শাসন সংস্কারের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। মালিক শাহের শাসনামলে কয়েকটি বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করেন।
সেলজুক রাজত্বের শাসন সংস্কার, সমৃদ্ধি এবং প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য মালিক শাহের সুযোগ্য এবং ব্যুৎপত্তি জ্ঞানসম্পন্ন উজির নিজামুল মুলকের অবদান ছিল অপরিসীম।
নিজামুল মূলকের বিচক্ষণতা, কর্মনৈপূণ্যতা, দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার জন্যই মালিক শাহের রাজত্বকাল মহিমান্বিত ও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
৬. রাজনৈতিক সংস্কার : নিজামুল মুলকের বহুবিধ কর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ম হচ্ছে 'সিয়াসতনামা'। রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের জন্য মালিক শাহের শাসনামলে নিলমুল মূলক ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
৭. মানমন্দির প্রতিষ্ঠা : নিজামুল মুলকের পরামর্শক্রমে সেলজুক সুলতান মালিক শাহ ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুরে একটি জ্যোতির্বিদ সম্মেলন আহ্বান করেন এবং সম্মেলনের মাধ্যমে একটি জ্যোতির্বিদ্যার চর্চার সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণীত হয়।
আব্বাসীয় শাসনামলে সেলজুক সুলতানদের যেগুলো অবদান ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো নিশাপুরে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রভূত উন্নতিকর মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করা।
৮. শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা : নিজামুল মুলক শিক্ষার অগ্রগতিতে এক অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। তিনি মনে করতেন শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এই জন্য শিক্ষার প্রসার, মান মন্দির প্রতিষ্ঠা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলো পরবর্তীকালে শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল।
৯. নিজামের নামে মাদ্রাসা নির্মাণ : নিজামুল মুলক মূলত একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন তার বাস্তব প্রমাণ ১০৬৫ খ্রিস্টাব্দে নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা।
জ্ঞানপিপাসু নিজামুল মুলক কায়রোতে অবস্থিত ইসমাঈলী শিক্ষায়তন আল-আজহার- এর প্রতীদ্বন্দ্বীরূপে বাগদাদে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
১০. সিয়ালতনামা রচনা : নিজামুল মুলকের সিয়াসতনামা রাজ্যের শাসন প্রণালির উপর লিখিত একটি গবেষণামূলক রচনা বলে মনে করা হয়।
সুলতান মালিক শাহের অনুরোধে এ গ্রন্থটি ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে রচনা করা হয়। এর মূল বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক নীতিমালা সম্বলিত একটি দার্শনিক নিবন্ধন।
গ্রন্থটিতে শাসন প্রণালি দরবার, বিচারকার্য, সামরিক বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং অর্থনৈতিক কার্যাবলির উপর ব্যবহারিক উপদেশ প্রদান করা হয় ।
১১. সুষ্ঠু কর ব্যবস্থা প্রচলন : নিজামুল মুলকের যুগোপযোগী ব্যবস্থার গ্রহণের ফলে সেলজুক সাম্রাজ্য কৃষি, শিল্প, ও বাণিজ্যতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
পারস্য ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে নিজামুল মুলক এরূপ একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যার ফলে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়।
তিনি সুষ্ঠু কর ব্যবস্থার প্রচলনের মধ্যদিয়ে সামন্ততন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সৈন্যদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করে তাদের নিকট থেকে নিয়মিত কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন।
১২. নতুন পঞ্জিকার প্রচলন : আলালের নামানুসারে এক নতুন সেলজুক সুলতান মালিক শাহ, জালালী পঞ্জিকার নামকরণ করা হয়। চন্দ্র মাসের পরিবর্তে সৌর মাস অনুযায়ী গণনার প্রথা চালু করেন।
মূলত নিজামুল মুলককে জালালী পঞ্জিকা প্রচলনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক ও কবি সাহিত্যিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম। প্রচলিত গণনা পদ্ধতির যাবতীয় ভুল সংশোধন করেও জালালী পঞ্জিকাটি রচনা করা হয়।
১৩. অন্যান্য কার্যাবলি : খলিফা মালিক শাহের শাসনামলে নিজামুল মূলক প্রধান উজিরের পদ অলংকরণ করে আব্বাসীয় খিলাফতের রাস্তাঘাট নির্মাণ, সরাইখানা নির্মাণ, সাম্রাজ্য পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি এবং রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রভূত উন্নতি বিধান করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক এক অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ইয়াহিয়া বার্মাকির পরে তিনিই ছিলেন এশিয়ার সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ শাসক ।
প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার সদগুণাবলি ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সর্বজনের সমাদৃত ছিলেন।
The History of Saracens' গ্রন্থে সৈয়দ আমীর আলী বলেছেন, এশিয়ার যে কয়েকজন সুদক্ষ উজির ও শাসকের জন্ম হয়, তন্মধ্যে সম্ভবত মালিক শাহের উজির তিনিই অন্যতম ছিলেন। মালিক শাহের শাসনামলে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।