সুলতান কালাউনের কৃতিত্ব আলোচনা কর
সুলতান কালাউনের কৃতিত্ব আলোচনা কর |
সুলতান কালাউনের কৃতিত্ব আলোচনা কর
- অথবা, সুলতান কালাউনের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
উত্তর : ভূমিকা : ইতিহাস পঠন-পাঠনে যে সকল বিষয় খুবই গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয় তার মধ্যে মিশরের মামলুক বংশের শাসন অন্যতম।
আর এ বংশের শাসকদের মধ্যে সুলতান কালাউন ছিলেন অন্যতম শাসক। তার রাজত্বকাল মিশর, সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অবসান, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, বহিঃশত্রুর মোকাবিলা এবং রাজ্য সুসংহতকরণে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
সেই সাথে বিচক্ষণ, জ্ঞানী, সাহসী ও প্রজাহিতৈসি গুণের কারণে সুলতান কালাউন প্রজাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা ও গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হন।
→ কালাউনের পরিচয় ও সিংহাসনারোহণ : সুলতান কালাউনের মূল নাম “আল মালিক আল মনসুর সাইফুদ্দিন কালাউন। তিনি ১২২২ খ্রিস্টাব্দে উরাল পর্বতমালা এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে।
তিনি ছিলেন তুর্কিদের কুমান শাখার অধিবাসী । প্রাথমিক জীবনে তিনি ছিলেন ক্রীতদাস। আইয়ুবীয় সুলতান আল মালিক আস সালিহ তার দেহরক্ষী বাহিনীর সৈনিক পদে নিয়োগ দেন কালাউনকে।
কালাউন অল্পসময়ের মধ্যে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। সুলতান রুকন উদ্দিন বাইবার্স-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাঈদ আল বারকা সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তখন উচ্চাভিলাষী কালাউন তাঁর নিজ কন্যাকে সাঈদের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। এদিকে সুলতান সাঈদকে তার ভ্রাতা সালামিশ সিংহাসনচ্যুত করে কৌশলে মামলুক সিংহাসনে বসেন।
কালাউন এবার সাঈদের পক্ষ ত্যাগ করে সালামিশের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। সালামিশ তার শাসনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
তখন ১২৭৯ সালে অতি সহজেই কালাউন মামলুক সিংহাসন দখল করেন। সুলতান কালাউন ১২৭৯-১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মামলুক সুলতান ছিলেন।1
সুলতান কালাউনের কৃতিত্ব : মিশরের দুর্দিনে ১২৭৯ সালে কালাউন মামলুক বংশের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বিশৃঙ্খলা, ষড়যন্ত্র ও নৈরাজ্যের মূলোৎপাটনের পাশাপাশি বৈদেশিক আক্রমণ কঠোর হস্তে মোকাবেলা করেন।
নিচে সুলতান কালাউনের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নির্মূল : মামলুক সুলতানদের উত্তরাধিকার নিযুক্ত করার কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণে প্রত্যেক সুলতানের ইন্তেকালের পর সিংহাসন নিয়ে ঘৃণ্য প্রসন সূচনা হতো।
কোনো সুলতানের মৃত্যু হলে তার নেতৃত্ব স্থানীয় আমিরদের সবাই রাজপদের প্রার্থী হতেন। তাই কালডিন শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর সব রকমের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করেন।
২. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ দমন : রুকনউদ্দিন বাইবার্সের মৃত্যুর পর থেকে কায়রোতে যে অরাজকতা বিরাজ করছিল তার সুযোগ নিয়ে সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা কারা সুনকুর বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেকে খলিফা দাবি করেন।
বাইবার্সের কয়েকজন প্রধান আমির, মেসোপটেমিয়া ও হামার আইয়ূবীয় শাহাজাদারা তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
দামেস্কের নিকটস্থ আল জেসুয়ার যুদ্ধে কালাউন সম্মিলিত বিরোধী শক্তি পরাজিত হন। যুদ্ধের পর বিদ্রোহীগণ পলায়ন করেন। অবশিষ্ট কয়েকজন রাজানুগ্রহ পেয়ে কালাউনের ভক্ত হয়ে যায়।
৩. মোঙ্গলদের দমন : সুলতান কালাউনের রাজত্বকালের অন্যতম উজ্জ্বল দিক হলো পারস্যের ইলখানি মোঙ্গলদের দমন। কারা সুনকুর ও অন্যান্য আমিরদের বিদ্রোহ দমনের পরেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কলহের সুযোগে পারস্যের ইলখানি মোঙ্গলরা আবাপা খান এবং তার ভ্রাতা মেজু খানের নেতৃত্বে সিরিয়ার আলেপ্পো দখলের পর আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার খ্রিস্টান শক্তির সহায়তায় প্রায় ৮০,০০০ সৈন্যর এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মিশর আক্রমণ করেন।
কালাউন ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে ১২৮০ সালে হিমস এর প্রান্তরে প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আবাগা খানের নেতৃত্বাধীন মোগল বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।
৪. ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান : বাইবার্সের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে কালাউন খ্রিস্টান ক্রুসেডার তথা ধর্মযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রবল সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে অস্ত্রধারণ করেন।
১২৮৫ সালে তিনি আল-মারকার অবরোধ করলে দীর্ঘ ৩৮ দিন পর তা হস্তাগত হয়। এরপর উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত ধর্মযোদ্ধাদের সর্বাপেক্ষা বড় ঘাঁটি ত্রিপলি ১২৮৯ সালে কালাউন কর্তৃক আক্রান্ত হয়।
সাইপ্রাসের রাজা ত্রিপলি সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও কালাউনের হাতে ত্রিপলির পতন ঘটে। ত্রিপলির রাজা সপ্তম বাইমন্ডের মৃত্যুর পর কালাউন বাতরুন ও লাটভিয়া জয় করেন।
ধর্মান্ধ ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেওয়ায় তাকে 'আল-মালিক আল-মনসুর' বলে অভিহিত করা হয়।
৫. কূটনৈতিক সম্পর্কে সাফল্য অর্জন : প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে সফল কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন সুলতান কালাউনের অন্যতম কৃতিত্ব।
সুলতান কালাউন বাস্তব অবস্থার গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করে খ্রিস্টান রাজ্যের রাজাদের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করেন।
১২৮১ সালে আবাগা খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র তাগুদার ইলখানি মোঙ্গল সিংহাসনে আরোহণ করে আহম্মদ নাম ধারণ করেন।
আহমদ কালাউনের দরবারে দূত প্রেরণ করলে উভয়ের মধ্যে সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এছাড়াও সুলতান কালাউন গোল্ডেন বোর্ডের মোঙ্গল খান, চীনের সম্রাট, হাফসবার্গের ও শ্রীলঙ্কার রাজার সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা স্থাপনে কালাউন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও দক্ষ কূটনীতিবিদের পরিচয় দেন।
৬. আল-মারিস্তান আল-মানসুরি প্রতিষ্ঠা : সুলতান কালাউনের জীবন ও রাজত্বকালের শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম জনহিতকর কীর্তি হচ্ছে কায়রোর উপকূলে “আল-মারিস্তান আল-মানসুরি” নামক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা।
হাসপাতাল হিসেবে এখানে বিভিন্ন রোগ যেমন- জ্বর, চক্ষুরোগ, আমাশয় প্রভৃতির জন্য পৃথক পৃথক বিভাগীয় কক্ষ ছিল। এখানে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় এবং ঔষধ প্রস্তুতের জন্য গবেষণাগার ছিল।
এ হাসপাতালে বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ করা হতো এবং রোগীদের জন্য বিশেষ শয্যার ব্যবস্থা ছিল। হাসপাতাল সংলগ্ন গ্রন্থাগারে চিকিৎসা, ধর্ম ও আইন বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ সংগৃহীত ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগের ইতিহাসে সুলতান কালাউন অতুলনীয় কৃতিত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী এক মহান শাসক। তিনি ছিলেন একজন ধর্মভীরু, সংস্কৃতিমনা, নির্ভীক, ন্যায়পরায়ণ, উদার ও তেজস্বী নৃপতি।
বিদ্রোহ দমন, শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক কূটনীতি এবং জনহিতৈষী কার্যাবলী দ্বারা সুলতান কালাউন মামলুক সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন। আর এজন্য ইতিহাস তাকে মামলুক বংশের ২য় শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।