সুলতান কালাউনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিসমূহ আলোচনা কর
সুলতান কালাউনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিসমূহ আলোচনা কর |
সুলতান কালাউনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, সুলতান কালাউনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : মিশরের ইতিহাসে যে কয়টি রাজবংশের ইতিহাস স্মরণীয় হয়ে আছে মামলুক রাজবংশ তন্মধ্যে অন্যতম। বাহারি মামলুকদের শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন রুকনউদ্দিন বাইবার্স।
কিন্তু ১২৭৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর রাজ্য জুড়ে বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে কালাউন সিংহাসনে আরোহণ করে রাজ্যের যাবতীয় বিদ্রোহ, বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ।কালাউনের প্রাথমিক পরিচয় সুলতান কালাউনের প্রকৃত নাম ছিল আল মালিক আল মনসুর সাইফুদ্দীন কালাউন আল আলফি।
তিনি ১২২৩ সালে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর তীরবর্তী অঞ্চল কিপচাক তুর্কি গোরে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে দেখতে কালাউন অত্যন্ত সুদর্শন হওয়ায় আইয়ুবী সুলতান আস সালিহ তাকে ১০০০ নিরহাম দিয়ে ক্রয় করেন।
ফলে তাকে অনেকে আলফি নামেও অভিহিত করত। সুলতান আস সালিহ তাকে নিজ দেহরক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ দেন ।
সিংহাসনারোহণ : বাহারি মামলুকদের শ্রেষ্ঠ সুলতান বাইবার্সের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাঈদ আল বারকা মসনদে বসেন। কালাউন তাঁর এক কন্যাকে সাইদের সাথে বিয়ে দিয়ে ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে চলে আসেন।
পরে সাইদকে পদচ্যুত করে তাঁর ছোট ভাই সালামিশ ক্ষমতা দখল করলে কালাউন তাঁর অভিভাবক নিযুক্ত হন।
পরে সুযোগ বুঝে ১২৭৯ সালে কালাউন দুর্বল ও অযোগ্য সুলতান আল সালামিশকে পদচ্যুত করে আল মালিক আল মানসুর সাইফুদ্দীন উপাধি গ্রহণ করে মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সুলতান কালাউনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি : সিংহাসনে আরোহণ করে কালাউন প্রথম পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দমন করার পর তাঁর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির বিন্যাসে মনোনিবেশ করেন।
নিম্নে সুলতান কালাউনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি বর্ণনা করা হলো :
(ক) সুলতান কালাউনের অভ্যন্তরীণ নীতি :
১. কারা শঙ্করের বিদ্রোহ দমন : বাইবার্সের মৃত্যুর সুযোগে সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা কারা সুনকুর বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে।
অন্যদিকে, ঐতিহাসিক ইবনে খল্লিকানও কারাশঙ্করকে সমর্থন নিয়ে তাঁর পক্ষে ফতোয়া জারি করেন। এর ফলে কালাউন এক ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে কারাশঙ্করকে বন্দি করেন। পরে অবশ্য তাঁর প্রতি সমর্থন জানালে তাকে, স্বপদে বহাল রাখেন।
২. বাহারি মামলুকদের ষড়যন্ত্র : মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ, ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের জন্য সুলতান কালাউন একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন।
তিনি তাদের একটি সুদৃঢ় দুর্গ বা বুরুজে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ফলে তারা পরে বুরুজি মামলুক নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই বুরুজি মামলুকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২,০০০ এর মতো।
কিন্তু বুরুজি মামলুকদের এই সফলতায় বাহারি মামলুকরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলে সুলতান বেশ কিছু বাহারি মামলুককে বন্দি ও হত্যা করে তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেন।
(খ) সুলতান কালাউনের বৈদেশিক নীতি :
১. মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : সুলতান কালাউন ক্ষমতায় আসার পর মোঙ্গলগণ পুনরায় তাদের মামলুক বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন। মোঙ্গলগণ আৰাগা খান ও তাঁর ভ্রাতা মোঙ্গল খানের সহায়তায় আলেপ্পো দখল করে মিশরের দিকে অগ্রসর হন।
কালাউন তাদের দমনে প্রায় ৮০,০০০ সৈন্য নিয়ে এগিয়ে যান। ফলে ১২৮০ সালে ঐতিহাসিক হিমসের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মামলুকগণ এ যুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়লাভ করে।
২. ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : কালাউনের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের সুযোগে মার্কারের হস্পিটালার নাইটগণ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন মুসলিম রাজ্য আক্রমণ করে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়।
কালাউন এক অভিযান চালিয়ে তাদের সাথে ১০ বছরের শাস্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে একরের নৃপতি, টটোসার টেম্পলার ও ত্রিপোলিসের প্রিন্সও অনুরূপ সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন।
কালাউনের ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে শ্রেষ্ঠ সাফল্য আসে ১২৮৯ সালে ত্রিপোলি বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি টায়ার, জাহফা, পাকালা, বেরিটার্স ও সিপিটালরের দুর্গসমূহ জয় করে নেন।
৩. ক্যাস্টাইল ও সিসিলির চুক্তি : উপরিউক্ত বিজয় লাভ শেষে সুলতান কালাউন ক্যাস্টাইলের শাসনকর্তা আলফানসো এবং সিসিলির রাজা জেমসের সাথে একটি প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি সম্পাদন করেন।
৪. জেনোয়ার সখি : অরগুলের রাজা কালাউনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রোমের পোপ এবং ফ্রান্সের সম্রাটের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। ফলে উরু জোট মোকাবিলা করার জন্য কালাউন জেনোয়ার রাজার সাথে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
৫. তায়ার ও বৈরুতের গন্ধ : সুলতান কালাউন তাঁর রাজনৈতিক কূটকৌশলে ভায়ার ও বৈরাতের রানি মার্গারেটের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফলে রানি মার্গারেট তাঁর রাজ্যের অর্ধাংশ ২০ বছরের জন্য ছেড়ে দিয়ে সুলতানের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন।
৬. ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্ক : কালাউনের সময় ভারতের শাসন ক্ষমতায় ছিল আলাউদ্দিন খলজীর নেতৃত্বাধীন মামলুক বা দাস বংশ। ফলে উভয় দাস বংশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা করে। এছাড়া এ সময় সুলতান চীনেও একটি বাণিজ্য বহর প্রেরণ করেছিলেন।
৭. কিপচাক রাজাকে স্বীকৃতিদান : এ সময় কিপচাকের রাজা তুফান মারজ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে সুলতান কালাউন তাকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সনদ ও যুদ্ধ বর্মসহ পতাকা প্রেরণ করেন।
৮. রুডলফ ও হাফসবার্গের সন্ধি : সুলতান এ সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য হাফসবার্গের শাসকের দরবারে একজন দূত প্রেরণ করেন। তাছাড়া রুডলফের রাজার সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাঁর সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি করেন।
৯. ইয়েমেন ও সিংহদের সাথে সন্ধি : সুলতান কালাউন ইয়েমেনের সাথে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তাছাড়া এ সময় সিংহলের রাজা সুলতানের দরবারে দূত প্রেরণ করলে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুলতান বাইবার্সের মৃত্যুর পর যখন মামলুক সাম্রাজ্য চরম বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হয়। তখন কালাউন আলোকবর্তিকার ন্যায় আবির্ভূত হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃবিশৃঙ্খলা দমন করেন।
তাছাড়া এ সময় বিভিন্ন দেশের সাথেও এ সময় তিনি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মূলত, বাহরি মামলুক সুলতান কালাউনের কারণেই অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে মামলুক বংশকে রক্ষা করে একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী মুসলিম শাসনে পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল।