স্থাপত্য ও চিত্রকলায় মামলুকদের অবদান আলোচনা কর
স্থাপত্য ও চিত্রকলায় মামলুকদের অবদান আলোচনা কর |
স্থাপত্য ও চিত্রকলায় মামলুকদের অবদান আলোচনা কর
- অথবা, স্থাপত্য ও চিত্রকলায় মামলুকদের অবদান ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : মিশরের মামলুক শাসকরা প্রায় দীর্ঘ আড়াইশত বছর অধিক সময় দাপটের সাথে শাসন করেন। তাদের এ দীর্ঘ শাসনামলে বাহারি মামলুকরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখেন।
তেরো শতকে যখন আরব জগৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পশ্চাদগমন করছিল ঠিক, এমন সময়ে মিশরে মামলুক শাসকরা আগমন করেন।
অসামান্য ও অসাধারণ স্থাপত্য ও চিত্রকলায় উনেষ ঘটেছিল এ মামলুক শাসনামলে। মিশরের ইতিহাসে এবং ফেরাউন যুগের পর এত উঁচুদরের শিল্প সৃষ্টি আর হয়নি।
কালাউন, আল নাসির এবং আল-হাসানের তৈরি মসজিদ, বিদ্যালয় ও সমাধিস্থলগুলো মুসলিম স্থাপত্যে প্রাণময় করে তোলে।
→ মামলুকদের পরিচয় : 'মামলুক' শব্দটি আরবি 'মালাক' হতে উদ্ভূত যার অর্থ অধিকারে থাকা। এক্ষেত্রে মিশরের আইয়ুবী সুলতানদের অধিকারে থাকা কিপচাপ তুর্কিদের মামলুক বা ক্রীতদাস বলা হয়েছে।
মামলুকদের অধিকাংশ ছিল তুর্কিদের কুমান গোত্রের অধিবাসী। উরাল পবর্তমালা এবং কাম্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাপক অঞ্চল ছিল তাদের আদি বাসস্থান, এক পর্যায়ে মোঙ্গল আক্রমণের শিকার হয়ে তারা পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মিশরে আগমন করেন।
চরিত্রগতভাবে তারা ছিলেন সাহসী ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তাদের এসব গুণাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে মিশরের আইয়ুবী সুলতান আস-সালিহ তাদের সমন্বয়ে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে রাণী শাজার-উদ-দার আইয়ূবীয় শাসনের অবসান ঘটে।
স্থাপত্য ও চিত্রকলায় মামলুকদের অবদান : নিম্নে স্থাপত্য ও চিত্রকলায় মামলুকদের অবদান সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো :
১. স্থাপত্যকলার মামলুক : মামলুক শাসনকাল যুদ্ধ-বিগ্রহে পরিপূর্ণ হলেও স্থাপত্য শিল্প ও চারুকলার উন্মেষ ঘটেছিল মামলুক যুগেই। মিশরের ইতিহাসে টলেমি এবং ফেরাউন যুগের পরে এত উঁচুদরের শিল্প সৃষ্টি হয় নি।
কালাউন, আল-নাসির এবং আল-হাসানের তৈরি মসজিদ, বিদ্যালয় ও সমাধিস্থলগুলোতে মুসলিম স্থাপত্য প্রাণময় হয়ে উঠেছিল। মামলুক আমলে একাধিক গম্বুজ ও মসজিদ তৈরি হয়েছিল।
প্রত্যেকটিই ছিল অপূর্ব সুষমামণ্ডিত। মামলুক আমলের মসজিদগুলো জ্যামিতিক নকশা ও কুফিক লিপিতে সুশোভিত ছিল। সবচেয়ে সুখের কথা মামলুক স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শনগুলোর কিছু আজও অক্ষত আছে।
২. শিল্পকলার অবদান : মামলুক আমলের ফলিত শিল্পের প্রায় সব শাখাই নির্মাণের সাথে যুক্ত। বিশেষ করে ধর্ম সংক্রান্ত স্থাপত্য শিল্পে এসব নিদর্শন আজো বিদ্যমান।
যেমন- ব্রোঞ্জের অসাধারণ নকশা করা মসজিদ দুয়ার, সুন্দর আরবীয় নকশা করা ব্রোঞ্জের ঝাড়বাতি, কুরআন রাখার জন্য সোনার উপর রত্নখচিত বাক্স ইত্যাদি।
এছাড়াও কুলপিতে নানা বর্ণের কাচের নকশ মসজিদের প্রচারবেদিতে কাঠের সূক্ষ্ম নকশা মামলুক যুগের শিল্পি সমৃদ্ধিরই প্রকাশ। আল-নাসিরের নগর দুর্গের (১৩১৮ খ্রি.) মসজিদের তোরণে কাচ ও চীনা মাটির উপর নকশা দেখা যায়।
৩. চারুকলা : মামলুক রাজত্বকালে মিশরে চারুকলা একটি গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের সূচনা হয়। সালাদীন যথার্থ বলেন, এ যুগের স্থাপত্য শিল্প মিশরের সারাসোনিয় শিল্পের ইতিহাসে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যমণ্ডিত।
বাহারি ও বুরুজী মামলুকগণ স্থাপত্যকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং তাদের আমলে কায়রোতে আনিন্দ্য সুন্দর ইমারত নির্মিত হয়।
মামলুক স্থাপত্য রীতি নুরিদ ও আইয়ুবী সুলতানদের নির্মিত ইমারত দ্বারা প্রভাবান্বিত। বলাই বাহুল্য যে, সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়া স্থাপত্যকলার কীর্তি মিশরের স্থাপত্য শিল্পে ছিল।
৪. কারুকলা : কারুশিল্পে মামলুক কারিগরগণ অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেন। মসজিদের উপকরণ হিসেবে ধাত দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হতো।
এক্ষেত্রে ব্রোঞ্জের ঝাড়বাতি এবং নকশাকৃত ব্রোঞ্জের নির্মিত দরজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অলঙ্করণের দিক হতে মামলুক যুগ বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী।
মসজিদের অভ্যন্তরে মোজাইক, এনামেল ও ইন-লের ব্যবহার দেখা যায়। এছাড়া মসজিদের বাতি এবং জানালার মোজাইকে মৃৎপাত্রের ব্যবহার রয়েছে।
গ্রাফিয়াতো রীতিতে নির্মিত এবং কায়রো থেকে সংগৃহীত একটি আকর্ষণীয় মৃৎপাত্রের ব্যবহৃত নকশা বলি নিঃসন্দেহে মামলুক শিল্পকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৫. রঙিন অক্ষর বা চিত্র দিয়ে গ্রন্থসজ্জা : মামলুক আমলের বড় ধরনের নিদর্শন ছিল পাণ্ডুলিপির অলংকরণ। তবে এ অলংকরণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কুরআনের পাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সঠিক রং তুলির টানে এক একটি পৃষ্ঠা রাঙ্গিয়ে তোলা এতটাই পরিশ্রম সাধ্য ছিল যে দিনে কুরআনের দুটি বা তিনটির বেশি পৃষ্ঠা সম্পূর্ণ অলংকরণ হতো না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্থাপত্য ও চিত্রকলায় মামলুক বংশের অবদান আজও ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
প্রায় সকল সকল মামলুক সুলতান স্থাপত্য ও চিত্রকলায় অসামান্য অবদান রাখেন। তাদের এ সুদীর্ঘ রাজত্বকালে স্থাপত্য ও চিত্রকলায় অবদান অভাবনীয়।
এর মাধ্যমে মামলুকরা এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কিছুটা সক্ষম হয়েছিল। মূলত তাদের মাধ্যমেই মুসলিম সভ্যতা পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করেছেন।